টাঙ্গাইলের নীরব সৌন্দর্য – বাসুলিয়া চাপরা বিল

টাঙ্গাইলের বাসাইল ও সখিপুর উপজেলার মাঝামাঝি বিস্তীর্ণ একটি জলভূমি, নাম বাসুলিয়া চাপরা বিল। এই নামটা অনেকের কাছে অচেনা হলেও, যারা একবার গেছেন—তারা জানেন এই বিলে এক ধরণের শান্তি মিশে থাকে। বিশাল বিলের বুক চিরে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা একটি প্রাচীন হিজল গাছ—এটাই এই এলাকার কেন্দ্রবিন্দু, সৌন্দর্যের প্রতীক এবং অনেকের কাছে ঐতিহ্যের চিহ্ন।

বর্ষাকালে পুরো বিল পানিতে ডুবে যায়। তখন চারপাশে শুধু জল আর আকাশের প্রতিচ্ছবি। রাস্তার দুই পাশে টলমলে পানি, মাঝে চলে যাওয়া একটি পাকা সড়ক আর একটানা বাতাসের ধারা—সব মিলে এক অবিশ্বাস্য পরিবেশ তৈরি করে। অনেকেই নৌকা নিয়ে বিলের মাঝখানে হিজল গাছ ঘুরে দেখতে আসেন। এখানে আপনি পাবেন হাতচালিত ডিঙ্গি নৌকা, আবার ইঞ্জিনচালিত বড় নৌকাও পাওয়া যায়। ঘণ্টাপ্রতি ভাড়া ১০০ থেকে শুরু করে ১০০০ টাকা পর্যন্ত, নৌকার আকার ও দরদাম অনুযায়ী।

গাছটির গল্পও কম আকর্ষণীয় নয়। জনশ্রুতি অনুযায়ী, বহু বছর আগে বর্ষার স্রোতে গাছটি ভেসে এসে এখানে থেমে যায় এবং সেখানেই সে শিকড় গাঁথে। এরপর শতবর্ষ ধরে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন—সব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে টিকে আছে এই হিজল গাছ। স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এটি একটি পূজনীয় গাছ, প্রতিবছর মাঘ মাসে এখানে সিদ্ধেশ্বরী পূজা হয়। তখন এই গাছকে কেন্দ্র করে সাতদিনব্যাপী একটি মেলাও বসে, যা লোকাল ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি।
খাবারের দিক থেকেও জায়গাটি এখন অনেক উন্নত। রাস্তার পাশে ছোট ছোট দোকান গড়ে উঠেছে—চা, ভাজা-পোড়া, ডাব, নাশতা সবই সহজলভ্য। তবে দুপুরের রোদ একটু কষ্টকর হতে পারে, তাই সকালে বা বিকেলের দিকেই যাওয়াটা সবচেয়ে আরামদায়ক। বিশেষ করে বিকেলের দিকে সূর্য যখন ধীরে ধীরে পশ্চিমে নামে, তখন বিলের জলে ছায়া পড়ে এক অসাধারণ দৃশ্য তৈরি হয়।

শীতকালে, বিলের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে সরিষা ফুলের হলুদ মাঠ, যেন প্রকৃতি নিজে হাতে রং তুলির আঁচড় দিয়েছে। এই সময়টাও ভ্রমণের জন্য দারুণ।

তবে এখানকার সৌন্দর্য যত বাড়ছে, মানুষের ভিড়ও ততই বাড়ছে। বিশেষ করে ঈদের ছুটিতে, শুক্রবার বা সরকারি বন্ধে যানজট, ভিড় এবং গাছের ওপর বাড়তি চাপ দেখা যায়। অনেকেই গাছের ডাল ভেঙে, উপরে উঠে ছবি তোলে—যা গাছটির দীর্ঘমেয়াদী জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি। এটি কেবল একটি গাছ না—এটি ইতিহাস, এটি স্থানীয় মানুষের অনুভূতি, এটি একটি সংস্কৃতির ধারক। আমাদের উচিত এর প্রতি সম্মান দেখানো এবং রক্ষা করা।

কিভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে সরাসরি মির্জাপুরের গোড়াই হয়ে সখিপুর রোড ধরে নলুয়া নামুন, সেখান থেকে সিএনজি বা মোটরসাইকেলে সহজেই পৌঁছে যাবেন বাসুলিয়া চাপরা বিলে। টাঙ্গাইল শহর থেকেও সহজেই যাওয়া যায়—পুরাতন বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসাইলগামী যেকোনো যানবাহনে উঠে, সেখান থেকে সিএনজি নিয়ে পৌঁছানো যায়।

এই বাসুলিয়া চাপরা বিল একটি ভ্রমণস্থান মাত্র নয়, এটি একটি অনুভূতি, যেখানে প্রকৃতি, সংস্কৃতি এবং মানুষের ইতিহাস একসাথে মিশে গেছে। প্রকৃতিকে ভালোবাসলে, আর ভিড়ের বাইরে প্রকৃত নির্জনতা খুঁজতে চাইলে, একবার ঘুরে আসা উচিত। তবে মনে রাখতে হবে—এই সৌন্দর্য টিকে থাকবে তখনই, যখন আমরা সেটাকে সম্মান দেখিয়ে সংরক্ষণ করবো।





21 Likes

যায়গাটি দেখতে অনেক চমৎকার। আপনার লিখা এবং ফটোগ্রাফি ও দারুণ। ইনশাআল্লাহ কোন একদিন টাঙ্গাইলে বেড়াতে যাবো।

3 Likes

ধন্যবাদ :heart: অবশ্যই টাঙ্গাইল আসবেন।

ধন্যবাদ সুন্দর এই পোস্ট শেয়ার করার জন্য! বাসুলিয়া চাপরা বিলের নীরব প্রকৃতি ও ঐতিহ্যের গল্প সত্যিই মুগ্ধকর। @mahfuz4223
সেই প্রাচীন হিজল গাছের টিকে থাকার কাহিনী অনেক কিছু শেখায়।
আপনি কি কখনও সেখানে নৌকায় চড়ে পুরো বিলটা ঘুরে দেখেছেন? কেমন অভিজ্ঞতা হয়েছে?

1 Like

ধন্যবাদ। @NandKK আমার গ্রামের বাড়ি ওখানেই এর জন্য এখানেই আমি বড় হয়েছি এবং এ সম্পর্কে আমি খুবই ভাল মত জানি এবং মাঝে মাঝে এখানে যাওয়া হয় এবং মন খারাপ থাকলে বিকেলে এখানে বসে থাকি।

1 Like

ছবি আর লেখা সবই অসাধারণ হয়েছে @mahfuz4223 ধন্যবাদ আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য।

1 Like

Wow, that’s sound like it is your escape from the world during the bad times. That’s good to know. Thanks for sharing. @mahfuz4223

2 Likes