মালাক্কা, মালয়েশিয়ার একটি অপূর্ব সুন্দর শহর, যা ইতিহাস ও আধুনিকতার এক অনন্য সংমিশ্রণ। মালাক্কা আমার অত্যন্ত প্রিয় জায়গাগুলোর একটি। অনেকে মালয়েশিয়ায় ঘুরতে এসে বিভিন্ন জায়গা ঘুরলেও, মালাক্কার সৌন্দর্য সম্পর্কে তেমন জানে না। আমার মতে, যদি কেউ গেন্টিং হাইল্যান্ড এবং মালাক্কার মধ্যে একটি বেছে নিতে বলে, তবে আমি নির্দ্বিধায় মালাক্কাকেই বেছে নেব।
মালাক্কা প্রথমবার গিয়েছিলাম আমি আর আমার হাসবেন্ড @PavelSarwar । এর পরেরবার গিয়েছিলাম আমি, আমার হাসবেন্ড, আমার ছোট ভাই, আর আমার কাজিন। তারপর আরেকবার গিয়েছিলাম আমি, আমার হাসবেন্ড, আমার বোন, বোনের হাসবেন্ড, আর আমার কাজিন। প্রতিটি সফরের কিছু সুন্দর মুহূর্তের ছবি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করলাম।
কুয়ালালামপুর থেকে মালাক্কার দূরত্ব প্রায় ১৩৪ কিমি, আর সড়কপথে ১৪৪.৯ কিমি। সময় লাগে আনুমানিক ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিট। নিজস্ব গাড়ি থাকলে প্রায় ৫০ রিঙ্গিতের পেট্রোল খরচ হবে। এছাড়াও, বাস, ট্রেন, কিংবা ট্যাক্সিতেও যাওয়া যায়। বাসের টিকিট ১০ রিঙ্গিত থেকে শুরু হয়ে ২৫ রিঙ্গিত পর্যন্ত পাওয়া যায়, আর ট্যাক্সির ভাড়া পড়ে ৩০০-৩৫০ রিঙ্গিত, যেহেতু এটি সংরক্ষিত রাইড। ট্রেনে গেলে খরচ হয় ৪০-৮০ রিঙ্গিত।
আমি ব্যক্তিগতভাবে বাসকে বেশি পছন্দ করি, তবে নিজস্ব গাড়ি থাকলে ভ্রমণ আরও উপভোগ্য হয়ে ওঠে। আমরা একবার বাসে গিয়েছিলাম, আর বাকি দু’বার গিয়েছিলাম নিজেদের গাড়িতে। গাড়িতে যাওয়ার সুবিধা হলো, আমরা পথের মধ্যে পোর্ট ডিকসনের বিভিন্ন মনোরম জায়গা ঘুরে দেখতে পেরেছিলাম এবং সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পেরেছিলাম।
মালাক্কা একদিনের ট্রিপের জন্যও আদর্শ। আমি পরামর্শ দেব, এমন সময় যাওয়া যাতে সূর্যাস্তের পরে সন্ধ্যাটা ওখানে কাটানো যায়, কারণ তখন পুরো শহরটি অপূর্ব আলোয় সেজে ওঠে, যা দেখতে অনেকটা ইতালির ভেনিস শহরের মতো মনে হয়। আমরা সেখানে দু’রাত থেকেছিলাম এবং পর্যটন এলাকার কাছেই থাকার জন্য বেশ কিছু হোটেল পাওয়া যায়, যেগুলোর ভাড়া ১২০ রিঙ্গিত থেকে শুরু।
সন্ধ্যার ঠিক আগে একটি বোট রাইড নিলে সবচেয়ে ভালো হয়। প্রতি ব্যক্তির জন্য ২০ রিঙ্গিত, আর যারা মালয়েশিয়ায় পড়াশোনা করে, তাদের জন্য ১০ রিঙ্গিত। কিছুক্ষণ পরপরই বোট পাওয়া যায়, যা শহরের দুই পাশের সৌন্দর্য এক অন্যরকম দৃষ্টিতে উপস্থাপন করে। এছাড়াও, মালাক্কার প্রতিটি গলি-রাস্তায় সুন্দর ওয়াল পেইন্টিং দেখা যায়, যা গোটা শহরকে সাজানো মনে হয়,সেখানে শত বছর আগের অনেক পুরোনো ভবন রয়েছে । এখানে মালয়েশিয়ার প্রথম মসজিদও রয়েছে।
মালাক্কার বিখ্যাত হারমনি স্ট্রিটে একসাথে মসজিদ, মন্দির, ও গির্জা আছে, যা সত্যিই এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত। আরও তিনটি বিখ্যাত মসজিদ আছে, যার মধ্যে একটি ছিল যেখানে একসময় ঢোল বাজিয়ে আজান দেওয়া হতো, কারণ তখন মাইক ছিল না এবং মানুষ যেন দূর থেকেও শুনতে পারে।
পর্যটন এলাকার কেন্দ্রবিন্দুতে একটি চার্চ ও ঘড়ির টাওয়ার আছে। এছাড়াও, “পাইরেটস অফ দ্য ক্যারিবিয়ান” এর মতো বিশাল এক জাহাজের ভেতরে একটি রেস্টুরেন্ট ও মিউজিয়াম আছে। আরেকটু হাঁটলে স্কাই টাওয়ার আছে, যেখান থেকে পুরো মালাক্কা শহর দেখা যায়। এটি ১৫ মিনিট সময় নিয়ে উপরে ওঠে ও আবার নিচে নামে। টিকিট মূল্য প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ২০ রিঙ্গিত, শিশুদের জন্য ১৫ রিঙ্গিত, আর বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের জন্য ১০ রিঙ্গিত।
মালাক্কাতে ট্যুরিস্টদের জন্য বিশেষ রিকশাগুলোও খুব আকর্ষণীয়, যেগুলো আলোকসজ্জিত ও নান্দনিক ডিজাইনের হয়। এছাড়া, চায়না টাউনের একটি বিখ্যাত রাস্তা রয়েছে, যেখানে হাঁটতে হাঁটতে ঐতিহ্যবাহী খাবার ও সংস্কৃতি উপভোগ করা যায়। শহরজুড়ে অসংখ্য সেতু আছে, প্রতিটি সেতুই ভিন্নভাবে সাজানো। আমরা যখন রাতের বেলা হাঁটতে বের হই, শহরের অপরূপ সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
ফিরতি পথে মূল বাস স্ট্যান্ড থেকেই বাস পাওয়া যায়, যা আগেই বলে দেওয়া হয়। মালাক্কার অন্যতম দর্শনীয় স্থান হলো মসজিদ সেলাত মেলাকা, যা মানবসৃষ্ট মালাক্কা দ্বীপের ওপর তৈরি এবং পানির ওপর স্থাপিত হওয়ায় এর সৌন্দর্য অতুলনীয়। যদি রাত যাপনের পরিকল্পনা থাকে, তবে অবশ্যই মেলাকা চাইনিজ মসজিদও ঘুরে দেখতে হবে। এটি দেখলে মনে হবে যেন কোনো চীনা স্থাপত্যশিল্পের বাড়ি, কিন্তু আসলে এটি একটি অসাধারণ মসজিদ। এটি মালাক্কার পর্যটন এলাকা থেকে প্রায় ৩৫ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত এবং গাড়ি নিয়ে সহজেই যাওয়া যায়।
শেষ কথা, মালাক্কা দেখতে যেমন সুন্দর, ঠিক তেমনই আবহাওয়াও বেশ গরম। তাই পানি, সানগ্লাস, ছাতা ও আরামদায়ক পোশাক সঙ্গে রাখা অত্যন্ত জরুরি।
আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলব, মালাক্কা এমন একটি জায়গা যেখানে বারবার যেতে মন চায়। প্রত্যেকবার নতুন কিছু আবিষ্কারের আনন্দ পাই, আর মালাক্কা আমাকে সবসময় মুগ্ধ করে। আমি যখনই মালাক্কা যাই, মনে হয় সবকিছুই ছবি তুলে ম্যাপসে দিতে থাকি—অস্থির হয়ে যাই! আমি আর আমার হাসবেন্ড দু’জনেই ম্যাপসে অবিরত কন্ট্রিবিউশন করতে থাকি। এটা আমাদের দু’জনেরই খুব ভালো লাগে। ম্যাপসে একসাথে অবদান রাখাটা যেন আমাদের সম্পর্ককে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে, একসাথে নতুন কিছু আবিষ্কার করার আনন্দ দেয়।
উল্লেখ্য, মালাক্কা ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় স্থান পেয়েছে এবং ২০০৮ সালে এটি মালাক্কা প্রণালীর একটি বিশ্ব ঐতিহ্য শহর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, যা পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময় গড়ে তুলেছে।