MotiurRahmanf's post
cancel
Showing results for 
Search instead for 
Did you mean: 
Level 7

ঘুরে আসুন রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজরিত আঠারবাড়ী জমিদারী

-মতিউর রহমান ফয়সাল

1.jpg

ময়মনসিংহ জেলার ইশ্বরগঞ্জ উপজেলা ঐতিহাসিক ভাবে বিখ্যাত। বিশেষত ব্রিটিশ আমলের রেল ব্যবস্থা ও নীল চাষের জন্য বিট্রিশদের কাছে ইশ্বরগঞ্জ উপজেলা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ব্রিটিশ আমলে ইশ্বরগঞ্জ এর নাম ছিল পিতলগঞ্জ। বিট্রিশরা যখন স্থানীয়দের নীলচাষে বাধ্য করত তখণ স্থানীয় ব্যবসায়ীদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। নীলকরদের অত্যাচার মেনে নিতে পারেনি ঈশ্বরপাটনী নামে স্থানীয় এক ব্যবসায়ী। সে ক্ষুব্ধ ও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। প্রতিবাদী হয়ে ওঠে সে, হয় দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। এক পর্যায়ে কোনো একদিন নীলকুঠির সাহেবগণ হাটে সমাগত মানুষদের নীলচাষ করতে বলে, ধমক দেয়, এমনকি চাবুক পর্যন্ত মারে। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে হাটে আসা মানুষগণ। চাবুকের আঘাতে জর্জরিত মানুষের হাহাকারে প্রকম্পিত হয় পিতলগঞ্জের আকাশ-বাতাস। ঈশ্বরপাটনী এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে শাল কাঠের বৈঠা হাতে নিয়ে দৌড়ে যায় এবং চিৎকার করে বলতে থাকে ‘সাহেব চাবুক মারাবন্ধ কর'। ইংরেজ সাহেবগণ এতেক্ষুব্ধ হয় এবং ঈশ্বরপাটনীরগায়ে চাবুক চালাতে থাকে। ঈশ্বরপাটনীর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় এবং হাতের বৈঠা দিয়ে ইংরেজ সাহেবের মাথায় আঘাত করে। এতে করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে নীলকুঠির সাহেব।রক্ত ঝরতে থাকে তার। রক্তক্ষরণে এক পর্যায়ে নীলকুঠির সাহেব মারা যায়। সৃষ্টি হয় ভীতসন্ত্রস্থ অবস্থা। পিতলগঞ্জের অবস্থা হয়ে পড়ে থমথমে। পিতলগঞ্জে যেনো ঝড় হইতে থাকে এই ঘটনায়।সমগ্র বাংলায়ও এর প্রভাব পড়ে। ঈশ্বরপাটনীও প্রাণে বাঁচতে পারেনি। ভেঙে যায় পিতলগঞ্জের হাট। তৎকালীন গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর চৌধুরী বর্তমান ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা সদরের জন্যে দত্তপাড়া চরনিখলা মৌজায় বাজার স্থাপনকরার জন্যে জমি দান করেন। তিনি ঈশ্বরপাটনীর নামের ঈশ্বরের সঙ্গে গঞ্জ যোগ করে বাজারের নাম দেন ঈশ্বরগঞ্জ।সেই থেকেই ঈশ্বরগঞ্জ নামের সূত্রপাত। (সূত্র: উইকিপিডিয়া)

ইশ্বরগঞ্জ উপজেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক স্থান আঠারবাড়ী। যেখানে গৌরীপুর জমিদারীর স্মৃতিচিহ্ন ও শাহী আমলের মানুষের পদচারণায় মুখর এক জনপদ অবস্থিত। ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, এ জায়গাটির নাম ছিল শিবগঞ্জ বা গোবিন্দ বাজার। জমিদার দীপ রায় চৌধরী নিজ পুত্রের নামে জমিদারি ক্রয় করে এ এলাকায় এসে দ্রুত আধিপত্য স্থাপন করতে সক্ষম হন এবং এলাকার নাম পরির্তন করে তাদের পারিবারিক উপাধি (রা) থেকে রায় বাজার রাখেন । আর রায় বাবু একটি অংশে এক একর জমির উপর নিজে রাজবাড়ী, পুকুর ও পরিখা তৈরী করেন। রায় বাবু যশোর থেকে আসার সময় রাজ পরিবারের কাজর্কম দেখাশুনার জন্য আঠারটি হিন্দু পরিবার সংঙ্গে নিয়ে আসেন। তাদের রাজ বাড়ী তৈরী করে দেন। তখন থেকে জায়গাটি আঠারবাড়ী নামে পরিচিত লাভ করে। দীপ রয় চৌধরী মৃত্যুর পর তার পুত্র সম্ভুরায় চৌধরী জমিদার লাভ করেন। তবে কোন পুত্র সন্তান না তাকায় তিনি নান্দাইল উপজেলায় খারূয়া এলাকা থেকে এক ব্রাম্মণ প্রমোদ রায় চৌধরীকে দত্তক এনে লালন পালন করে এক সময় জমিদারী কর্ণধার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। ময়মনসিংহ কিশোরগঞ্জ মহাসড়কে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সদর থেকে ১৪ কিলোমিটার পূর্বে কিছু অগ্রসর হলেই চোখে পড়বে জমিদার বিশাল অট্টালিকা। যা প্রায় ২৫০ শত বছরের পুরোনো।

জমিদার প্রমোদ রায় চৌধুরী ছিলেন কলকাতার শান্তি নিকেতনের ছাত্র। যার কারণে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে ছিল অন্য রকম সম্পর্ক। প্রিয় ছাত্রের আমন্ত্রণে ১৯২৬ সনের ১৯ ফেব্রুয়ারি বিশ্বকবির পদচারণায় মুখোরিত হয় এই জমিদারবাড়ী। রবীন্দ্র গবেষকদের কাছ থেকে জানা যায়, নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর শুভেচ্ছা বিনিময় ও শান্তি নিকেতনকে বিশ্বনিকেতন করে গড়ে তোলার জন্য নৈতিক ও আর্থিক সমর্থনের লক্ষ্যে ১৯২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় আসেন। এক সপ্তাহ ঢাকায় সরব উপস্থিতি শেষে তিনি ময়মনসিংহে আসেন। 2.jpg

বেশ কয়েকজন প্রাবন্ধিকের লেখা থেকে জানা যায়, ১৯ ফেব্রুয়ারি সকালে ঈশ্বরগঞ্জের আঠারবাড়ীর উদ্দেশে কবি রওনা দেন ট্রেনযোগে। খবর পেয়ে ঈশ্বরগঞ্জ ও গৌরীপুরের শত শত লোক একনজর দেখতে ট্রেন থামিয়ে দেয় ঈশ্বরগঞ্জ সদরে। কিছুক্ষণ পর আঠারবাড়ী রেলস্টেশনে পৌঁছালে কবিকে হাতির পিঠে চড়িয়ে স্লোগান দিতে দিতে জমিদার বাড়ির মূল ফটকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই কবিকে সোনার চাবি উপহার দেন জমিদার প্রমোদ চন্দ্র রায় চৌধুরী। সেই চাবি দিয়ে তিনি কাছারিঘরের মূল ফটকের দরজা খোলেন। পরে মধ্যাহ্ন ভোজের পর কবির জন্য আয়োজন করা হয় বাউল, জারিসারি, মারফতি, পালাগানসহ এলাকার ঐতিহ্যবাহী গেটু গানের আসর।

রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজরিত সেই কাছারীঘর এখন প্রায় ধ্বংসাত্বক। শুধুই স্মৃতিটুকু ধরে আছে।এই জমিদারবাড়ী ঘিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আঠারবাড়ী ডিগ্রি কলেজ। ডিগ্রি কলেজ প্রধান ফটক পার হয়ে ভিতরে ঢুকলে চোখে পরবে বিশাল খেলার মাঠ এবং তার বিপরীতে জমিদার বাড়ীর অন্দরমহল। এগিয়ে গেলে পুরোনো শ্যাওলাপরা ভবনগুলো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে। অন্দরমহলে নাচের জায়গা, চাকরবাকর থাকার ঘর, সুবিশাল একটি অট্রালিকা চোখে পরবে যার প্রতিটি খাঁজ সুন্দর কারুকাজ করাছিল দেখে বুঝা যায়। এসব পার হয়ে কলেজের ভিতরে গেলে কাছারি বাড়ী ও দরবার হল। ভবনের উপরে রয়েছে সুবিশাল এক টিনের গম্ভুজ। পিছনে সারি সারি গাছ। সামনে রাণীপুকুর। যে পুকুরে রাজবাড়ীর মানুষজন গোসল করতো। এই পুকুরে আসার জন্য অন্দরমহল থেকে গোপন গুহা ছিল মাটির নিচ দিয়ে। এই পুকুরে এক সময় কুমির ও বড় বড় মাছ ছিল বলে ধারণা করেন ইতিহাসবীদরা।

 

ময়মনসিংহ শহর থেকে আঠারবাড়ী রাজবাড়ীতে যেতে চাইলে ট্রেন, বাস অথবা সিএনজি করে যেতে পারবেন। কিশোরগঞ্জগামী বাসে ইশ্বরগঞ্জ নেমে আঠারবাড়িতে যাওয়ার জন্য অটো বা সি এনজি গাড়ি পাবেন। আঠারবাড়ি বাজার থেকে হেঁটে বা রিকসা করে রাজবাড়ীতে যেতে পারবেন। ট্রেনে আসলে আঠারবাড়ী স্টেশন থেকে ১৫ মিনিট হাঁটলেই রাজবাড়ী।


সময় সুযোগ মতো বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন। দিনে দিনে ঘুরে আসতে পারুন বন্ধুবান্ধব নিয়ে। ময়মনসিংহের ইতিহাস ঐতিহ্য জানা আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব। তবে সংস্কার কাজ করে এই রাজবাড়ীকে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে এটিকে পযর্টকদের কাছে আরও সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। প্রশাসনিক ভাবে নজর দিলে এটি ময়মনসিংহের অন্যতম সুন্দর বেড়ানোর জায়গা হতে পারে।

-লেখক: আইনজীবী ও কলাম লেখক

 

 

আঠারবাড়ী জমিদার বাড়ী, আঠারবাড়ী, বাংলাদেশ