ভাগ্যকূলের জমিদার (যদুনাথ রায় বাহাদুর পরিবার) বাড়িগুলো

ভাগ্যকুল জমিদার বাড়ি বাংলাদেশ এর মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার ভাগ্যকুল গ্রামে অবস্থিত এক ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি.

আনুমানিক ১৯০০ শতকে জমিদার যদুনাথ রায় এই জমিদার বাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন।
যদুনাথ রায় ছিলেন মূলত একজন ব্যবসায়ী। তিনি বরিশাল থেকে সুপারি, লবণ ও শাড়ি
আমদানি করে কলকাতার মুর্শিদাবাদে রপ্তানি করতেন। জমিদার যদুনাথ রায় ছিলেন পাঁচ সন্তানের জনক।
তাই তাদের জন্য আলাদা আলাদাভাবে আরো চারটি বাড়ি তৈরি করেন।
যেগুলো বর্তমানে কোকিলপেয়ারি জমিদার বাড়ি, জজ বাড়ি ও উকিল বাড়ি নামে পরিচিত।
আর মূল বাড়িটি ছোট ছেলে নবকুমারকে দিয়ে দেন।
এই জমিদার বংশধররা ব্রিটিশ আমলে কয়েকজন বাঙালী ধনীদের মধ্যে একটি ধনী পরিবার ছিল।
জমিদারদের মধ্যে হরলাল রায়, রাজা শ্রীনাথ রায় ও প্রিয়নাথ রায়ের নাম উল্লেখযোগ্য।
তারা তাদের কর্মযজ্ঞের ফলে ব্রিটিশদের কাছ থেকে রাজা উপাধি লাভ করেন।
তখনকার সময় এই জমিদার বংশধররা সকলেই ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত।
জমিদার বংশধরদের অধিকাংশ এখন ভারতের মুর্শিদাবাদে বসবাস করতেছেন।
তবে এই বংশধরের অনেকে এখনো এখানে বসবাস করতেছেন।
ভাগ্যকুল জমিদারদের The East Bengal River Steamer
নামে একটি স্টিমার কোম্পানি ছিলো যা ১৯০৭ সালে নৌ ব্যবসায় যুক্ত হয়।
(ঘাটের কথা : গোয়ালন্দ by হোসাইন মোহাম্মদ জাকি, পৃষ্ঠা: ১৮)

ভাগ্যকূল বংশের যেমন ছিল প্রভাব প্রতিপত্তি তেমনি ছিল বিপুল ধনসম্পদ। প্রথমে এদের বংশ পদবী ছিলো কুন্ডু। হঠাৎই তারা অগাধ ধনসম্পত্তির মালিক বনে যান। তাঁদের এ প্রাপ্তি নিয়ে কিংবদন্তী কথিত আছে, এই কুন্ডু বংশে জনৈক পূর্বপুরুষ দেবীলক্ষ্মীকে আঁকড়ে রেখে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটান। অর্থাৎ তারা বিপুল ধণ-সম্পদের অধিকারী হন। বিপুল অর্থের মালিক হওয়ার পর তাঁরা পদ্মাপাড়ে সুদৃশ্য বাড়ী-ঘর নির্মাণ শুরু করেন। তখন থেকেই পদ্মাপাড়ের এই বাড়ীগুলো ভাগ্যের-কূল অর্থাৎ ভাগ্যকূল নামে পরিচিত হয়ে উঠে।

এই জমিদার পরিবারটি প্রথমে রায় এবং পরে ব্রিটিশ সরকার হতে রাজা উপাধি প্রাপ্ত হন। জনশ্রুতি আছে, জমিদার বাড়ীটির ভাগ্য পরিবর্তনের পর থেকে দেবী লক্ষ্মীর আদেশে তাঁরা খুব দান-দক্ষিণা করে যেতেন। একদিন এক অশীতিপর বৃদ্ধ ভিক্ষুক বহু কাকুতি মিনতি করেও জমিদার বাড়ী থেকে কোন ভিক্ষা না পেয়ে বিফল মনোরথ হয়ে বিষন্নবদনে ফিরে যাচ্ছিলেন। বৃদ্ধের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে দেবী লক্ষ্মী তাঁকে দর্শন দান করলেন এবং বিষন্নবদনের কারণ জিজ্ঞেস করলেন, বৃদ্ধ সবিস্তারে তা প্রকাশ করলে দেবী তাঁর কথা বিশ্বাস করলেন না। বৃদ্ধ ভিক্ষুকের মনোকষ্টের কারণে কুন্ডুরা পদ্মার ভাঙন কবলিত হয়ে তাঁদের অগাধ ধণসম্পত্তি আস্তে আস্তে খোঁয়াতে থাকে।

জমিদারদের মধ্যে হরলাল রায়, শ্রীনাথ রায়, জানকি নাথ ও প্রিয়নাথ রায় উল্লেখযোগ্য। এরা ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে লবনের ব্যবসায় প্রভুত উন্নতি সাধন করে প্রচুর ধণ সম্পদের মালিক বনে যান এবং বিভিন্ন জনহিতকর কাজ করে তাঁরা ইংরেজদের নিকট হতে ‘রাজা’ উপাধি লাভ করেন। বংশের পরিধি বাড়ায় জমিদার পরিবারটি ৭টি হিস্যায় ভাগ হয়ে যায়।
রাজা গুরুন্ন প্রসাদের দুই পুত্র মথুরামোহন রায় ও প্রিয়মোহন রায় ভাগ্যকুলের বর্তমান ওয়াপদা অফিসের ভবনটিতে বসতি স্থাপন করেন, এ পরিবারেই জন্মেছিলেন বিখ্যাত ক্রিকেটার পঙ্কজ রায়। হরিপ্রসাদ রায় ১৮১৯ সালে মারা গেলে গুরুন্নপ্রসাদ রায় ভ্রাতার বংশ রক্ষার্থে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র হরলাল রায়কে ১৮৩০ সালে পৌষ্যপুত্র দান করেন, হরলাল মাত্র ২৬ বছর বয়সে বসন্ত রোগে মারা গেলে স্ত্রী মাণীক্যময়ী নিজের ৬ বছর বয়সী ছোট ভাই হরেন্দ্রলাল কে পৌষ্যপুত্র হিসাবে গ্রহণ করেন। ভাগ্যকূলের স্থানীয় জমিদার হরেন্দ্রলালকে ১৯১৪ সালে বৃটিশ সরকার ‘রায় বাহাদূর’ খেতাবে ভূষিত করেন। তারও আগে তিনি ১৯০০ সালে ভাগ্যকূল হরেন্দ্রলাল উচ্চ বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু করেন। ভাগ্যকূলের জমিদাররা মুন্সীগঞ্জ সদর হাসপাতাল, হরেন্দ্রলাল পাবলিক লাইব্রেরী, ঢাকার মিডফোর্ড হাসপাতালের তিনটি ওয়ার্ড ও শ্রীনগর থানা হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি নিজে স্টীমার ও ৩৫ হাজার টাকার ওয়্যারবন্ড ক্রয় করে ভারত বর্ষের অসহযোগ আন্দোলনে সহযোগীতা করেন। জমিদার হরেন্দ্রনাথ রায়ের আমলে ১৯১৬ সালে খাজনা আদায়ের জন্য রাড়িখালে নবাব কাচারী প্রতিষ্ঠিত করেন, সেটি এখন রাড়িখাল ভূমি অফিস। নুতন অফিসের পাশে পুরনো ভগ্ন কাচারী ঘরটি এখনো কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে।
ভাগ্যকূল জমিদারের নিজস্ব স্টিমার কোম্পানিটির নাম ছিল ইস্টবেঙ্গল রিভার স্টিমার কোম্পানি। তাঁদের নিজস্ব কোম্পানির জাহাজ তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে আসাম এবং কলকাতায় মালামাল নিয়ে চলাচল করতো।
ভাগ্যকূলের জমিদারদের ইউনাইটেড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাংক নামে একটি নিজস্ব ব্যাংক ছিল। নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জে ব্যাংকের কার্যালয় ছিল। পাট ও বড় বড় আড়ৎদারী ব্যবসাসহ নারায়ণগঞ্জে বেশির ভাগ পাটের গুদামের মালিক তাঁরাই ছিলেন। এছাড়া নিজস্ব পুকুর ও দিঘীতে তাঁরা মাছ চাষ করতেন। বাড়ির দক্ষিণে পুকুর, সামনে পুকুর, বাড়ির চতুর্দিকে ঘুরে বেড়ানোর জন্য তৎকালীন সময় ইটের সলিং করা রাস্তা ছিল। রাস্তার চারিদিকে লাইট পোষ্টের (বিজলী বাতি) ব্যবস্থা ছিল। ভাগ্যকূলের জমিদাররা বিকেল বেলা টানা রিক্সায় করে (টমটম গাড়ী) বাড়ির চার দিকের বাগান ঘুরে বেড়াতেন।

12 Likes

So well written @KamaruzzamanKamal . so many history which are known by locals only.
Thanks for sharing.

1 Like

অনেক ভালো লিখেছেন, তথ্য বহুল একটি পোস্ট @KamaruzzamanKamal
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ