পর্বতারোহণের নেশা আজ প্রায় এক যুগ থেকে। সব পিছুটান ছেড়ে কেন যে বার বার অরণ্যে যাই জানি না। ঘনিষ্ঠ দেরও জানার আগ্রহ, কেন শুধু শুধু কষ্ট করে পাহাড় চড়ি। আরামদায়ক হবে এমন অনেক ঠিকানা আছে। তবে পাহাড় আরাম-আয়েশের জায়গা নয়। পাহাড়ি অঞ্চল টাই এমন, পরিশ্রম করে চলতে হয়। প্রতিক্ষণ টিকে থাকার লড়াই। পাহাড়ি অঞ্চলে কষ্ট করে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে হয়। গন্তব্যে পৌঁছানোর এই সফলতাই হচ্ছে মনের চুড়ান্ত তৃপ্তি।
তখন আমি বেরিয়ে ছিলাম সাকা হাফং এর উদ্দেশ্যে। পাহাড়ের টানে আবারও বান্দরবান ফিরে আসি। সাকা হাফং এর আসে পাশের অঞ্চল এখনো অরক্ষিত এবং এই অঞ্চলের বেশির ভাগ পাড়ায় অবস্থান করা তেমন সুবিধাজনক নয়। এর পাশাপাশি আরও অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।
আলোচনা সাপেক্ষে সতর্কতা অবলম্বনে আমরা রাতের পরিকল্পনা করি। এরপর থানচি থেকে দূরের এক গন্তব্যস্থল থেকে রাত ১১টায় ট্রেক শুরু করি। ডিসেম্বরের এই শীতের তীব্রতা কতটুকু সাংঘাতিক হতে পারে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম। জোছনার রাত ছিল, আমার দলের বাকি দের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে সামনের দিকে এগোছিলাম। ঘন্টা খানেকের মধ্যে থানদুইপাড়া পেড়িয়ে যাই। পাড়া থেকে নেমে রিমাক্রি খালে এসে পৌছাই। সবাই খালের পার ধরে এগিয়ে যেতে থাকি। এর মাঝে আমাদের বেশ কয়েকবার খাল পারাপার করতে হয়। খাল পারাপার করার ফলে আরও ঠান্ডা সহ্য করতে হচ্ছিল তার সাথে সাথে ভয় করছিল প্রচন্ড। আর এইজন্য ভয় করছিল কারণ এ.এল.পি(আরাকান লিবারেশন পার্টি) এসব এলাকা দিয়ে চলাচল করে, অসতর্ক হলেই তাদের হাতে ধরা পরার সম্ভাবনা রয়েছে। টর্চলাইট খুব সীমিত ভাবে ব্যবহার করছিলাম। অনেককে এমনটাও বলতে শুনেছি এখানকার প্রায় সকল পাড়ায় এ.এল.পি এর শ্বশুরবাড়ি । কথাটির সত্যতা কতটুকু তা আমার ঠিক জানা নেই। এরকম অনেক কথা শুনেছি এই বিচ্ছিন্নতা বাদী সংগঠনের ব্যপারে। তাই একরকম ভিত হয়েই এগোচ্ছিলাম।
নির্জনতা কি? এবং কতটা ভীতিকর হতে পারে তা যেন আর জানতে বাকি নেই। আমার চারপাশের অরণ্যে ঘেরা এ পরিবেশকে ভেদ করে যতোই সামনের দিকে এগোচ্ছিলাম রোমাঞ্চ যেন ততই বাড়ছিল। এগোতে এগোতে পেছনে কত কিছুই না ফেলে এসেছি। নানান ভাবনা চিন্তা মাথায় খেলছিল। হয়তো আর কিছুটা দূরে নেফিউ ঝিরিপথের দেখা মিলবে। তখন হয়তো ঘড়িতে রাত একটা বা দের টা বাজে। হঠাৎ খালের ওপার পাহাড় থেকে নেমে যাওয়া সরু এক রাস্তা থেকে কয়েকটি টর্চলাইটের আলো খালের দিকে এগিয়ে আসছিল। আমরা সকলে তখন প্রচন্ড ভয় পেয়ে যাই। সকলে ধিরে ধিরে পেছনে চলে আসতে শুরু করি, হঠাৎ খালের ওপার থেকে জোর গলায় একটা কথা আমার কানে ভেসে আসলো,
—টুরিস্ট, টুরিস্ট আমরা টুরিস্ট ভাই।
স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেললাম। তারা একদল টুরিস্ট জেনে ভয় কাটলো। এরপর তারা খালের এ পারে আসলেন। আমাদের দলের মনির ভাই তাদের প্রশ্ন করলেন,
— আপনাদের পরিচয়? কোথা থেকে আসছেন?
তাদের থেকে কেউ একজন বললেন,
— আমরা কুয়েট এর ছাত্র।
একথা শোনা মাত্র আমি টর্চ টা তাদের দিকে নিয়ে দেখি। কারণ আমার জানা ছিল যে কুয়েট এডভেঞ্চার ক্লাব নামে একটি ক্লাব আছে। আমার মনে হয়েছিল ক্লাবের কেউ হতে পারে। তখন টর্চের আলোয় আমি ভালো করে খেয়াল করে দেখি এইটা তো শাকিল আহামেদ ভাই। আমরা একই এলাকার এবং আমাদের মাঝে ঘনিষ্ঠ বন্ধন রয়েছে। আমি কোনো দিনও ভাবি নাই যে ভাইজানের সাথে আমার এভাবে দেখা হয়ে যাবে। রাত দের টায় যদি আপনার চিরচেনা কারোর সাথে লোকালয়ের থেকে দূরে গভীর অরন্যে হঠাৎ দেখা হয়ে যায় তার চেয়ে কাকতালীয় আমার মনে হয় না আর কিছু হতে পারে। চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে এই মুহূর্তটা।
যাইহোক এই ঘটনার পর তারা আমাদের সাথেই আসলেন। কারণ তারাও সাকা হাফং সামিট করবেন। আমরা তাদের সঙ্গে নিয়ে আমাদের মতো করে হাটতে শুরু করি। তবে এবার আমাদের পথের সবচেয়ে কঠিন অংশে এসে পৌঁছাই। পথের এ অংশে এসে পাথরের আকৃতি আগের তুলনায় বিশাল। এক একটা পাথর যেন হাতির তুলনায় বড়, ঠিক আমিয়াখুম যেতে রাজা পাথরের মতন। ওই পাথরে দাঁড়িয়ে নিজেকে যেন খুব ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল। মনের মাঝে হাজারো প্রশ্ন, রাতবেরাতে কোন বন বাদাড়ে ঘুরে বেরাচ্ছি। চলতে চলতে একটা সময় নেফিউ ঝিরির প্রবেশ পথ পাওয়া গেল। তবে প্রবেশ পথ টি খালের ঠিক ওপারে। এ সময় টায় আমাদের প্রতিকূল মুহূর্ত গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতা হয়। এর আগে বর্ষায় সাংগু, টোয়াইন খাল পেড়িয়েছি। খুব খারাপ দিন দেখেছি জীবনে তবে নেফিউ ঝিরির মুখে রেমাক্রি পারাপার অসহনীয় ছিল। কিছুক্ষণ আগে যে কয়বার খালে হাটুজল পারাপার করেছিলাম এবার জল কোমড় অব্দি। কুয়াশার জন্য চোখের সামনে শুধু চার হাত দূর অব্দি দেখতে পাচ্ছিলাম। এরকম সময়ে আমাদেরকে কোমড় অব্দি জলে নেমে পার হতে হয় রেমাক্রি।
রেমাক্রি থেকে উঠে নেফিউ ঝিরিপথে প্রবেশ করি। নেফিউ ঝিরি আমার কল্পনা চেতনার চেয়ে অন্যরকম ছিল। অসংখ্য ঝিরিপথ দিয়ে হেটেছি তবে নেফিউ ঝিরিপথের মতো আমি আগে কক্ষনও পাই নাই। ঝিরির শুরু থেকে শেষে অব্দি বোল্ডার আকৃতির পাথরে সজ্জিত। ঝিরি দিয়ে এখন শুধুই ওপরের দিকে ওঠা, এগোতে এগোতে ফজরের ওয়াক্তে আমরা বিরতি নেই। এক দিকে আগুন জ্বালিয়ে কয়েকজন হাত পা গরম করছে অন্য দিকে বাকিরা নামজ আদায় করছিল। চা বিস্কুট খেয়ে আমরা আবারও ওপরের দিকে উঠতে শুরু করি। হালকা আলোকিত হতে লাগলো চারিদিকে। এসময় আমরা চিকন কালা বা নেফিউ জঙ্গলে প্রবেশ করি। এই জঙ্গল নিয়েও শত রকম গল্প-কাহিনী আছে চারিদিকে। তাদের বেশ কিছু গল্প শুনেছি, আমার মিছে মনে হয়েছে। এমনকি এ জঙ্গলকে ঘিরে রেডিওতে গল্পের প্রচার হয়েছে। জঙ্গলে অবস্থানের সময় আমরা এরকম আজব চিন্তা না করে নিজেদের মতো করে হেটেছি। চলতে চলতে নেফিউ ঝর্ণার পাশ দিয়ে ঝর্ণার ওপর ঝিরিপথে নেমে যাই। ঝিরি দিয়ে উঠতে উঠতে আমরা পৌছে যাই সাকা নিচে দিয়ে চলে যাওয়া সবচেয়ে কাছের সড়কে। এ সড়কে এখনো কোনো জনসাধারণের চলাচল করে দেওয়া হয় না, কারণ সেনাবাহিনীর ১৬ ইঞ্জিনিয়ার্সক(16 ECB) এর তত্তাবধানে সবে মাত্র নির্মাণ কাজ চলছে।
তখন সকালের আলো বেড়িয়েছে, আমরা তারাতাড়ি দৌড় দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে ওপরে উঠে যাই। রাস্তাটি পেরিয়ে ঠিক ভাবে ওপরে উঠতে পারলেও কিছুক্ষণ পরে আমরা টের পাই আমাদের থেকে কিছু দূরত্বে কয়েকজন সেনা সদস্য দাঁড়িয়ে আছে। তাদের গলার স্বর অস্পষ্ট ভাবে হলেও আমাদের কানে আসছিল। আমরা তৎক্ষনাৎ মাথা নিচু করে বসে পরি। এভাবে প্রায় দের ঘন্টা লুকিয়ে থাকতে আমরা বাধ্য হই। এক পর্যায়ে সেনা সদস্য রা সে জায়গা ত্যাগ করে, অন্যদিকে আমরা উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত উপরে দিকে উঠে যাই।
তখন আমাদের দের ঘন্টা অপচয় হয়েছে তাই আর দেরি না করে এক দমে উপরে উঠতে থাকি। এসময় আশেপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। ক্লান্তিকর ছিল এতটুকু পথ, ঝিরিতে পানির শেষ ছোয়া পাই এরপর কাছে যতটুকু পানি ছিল তা দিয়েও হচ্ছিল না। এবার চূড়ান্ত পথ বাকি, অর্থাৎ বাশঝাড় বেয়ে ওপরে উঠতে হবে। দলের সবচেয়ে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও এসময় আমি কেমন করে জানি দলের অধিনায়ক এর মতোন একেবারে সামনে ছিলাম। বেশ খানিক ওঠার পর অবশেষে ফাকা জায়গার দেখা মাঝখানে একটা গর্ত। এটাই সাকার চূড়া, অবশেষে সামিট সফল।
এই ছিল আমার রোমাঞ্চকর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা।
SHTanim Photograph.
Tweet/Insta/Fb@shtanimdewan