হোম কোয়ারেন্টাইন চলছে পূর্বের ভ্রমনের স্মৃতিচারণ করছি ।
৬৯তম দিনঃ ২০ই জুলাই ২০১৮
মানালী শহরে প্রায় ৩ দিন ধরে ছিলাম , থাকার জন্য বেঁছে নিয়েছিলাম ওল্ড মানালীর জঙ্গলের শেষ দিকের একটা হোস্টেল । এদিকে আর একটা জোস্টেল ছিলো (ব্যাকপ্যাকারস হোস্টেল ) । মানালী মূল শহর থেকে ৩ কি.মি. মানু টেম্পলের রাস্তার শেষ দিকে , এই দিকে কোলাহল নেই বললেই চলে । প্রায় আড়াই মাস ঘর থেকে বেড়িছিলাম , মানালীর পর যেহেতু নেটওয়ার্ক নেই ফোনের তাই শেষ মেশ পুরোদমে এনার্জি নিয়ে সামনের দিকে আগাবো বলেই নির্জন যায়গা বেছে নেয়া । থুকপা, নুডুলস,ডিম পোচ, ব্রেড খেয়েই মোটামুটি ভাবে ৩ দিন অনায়েশে কাটিয়ে দিলাম ।
আমি যে হোস্টেলে ছিলাম সেখানে পরিচয় হয় “আন্দ্রে” নামে এক ইতালীয়ান বন্ধুর সাথে। তার বয়স ৫৫ এর কাছাকাছি। আগের রাতে আমার বুড়া বন্ধু আমাকে ট্রিট দিয়েছে কারন আজ চলে যাবো বলে। রাতে তেমন ঘুমাতে পারি নি, আন্দ্রে’র শরীর টা অনেক খারাপ হয়ে যায় মধ্য রাতে। সারা রাত বমি করে একাকার। হাসি খুশি মানুষ নিমিষেই মুখে অন্ধকার নেমে এসেছিলো রাতে। রাতে হাল্কা তার সেবা শুশ্রূষা করেছিলাম। সকাল ঘুম থেকে উঠে দেখি কিছুটা সুস্থ কিন্তু জ্বর ছিলো হাল্কা। হোস্টেলের সহকারীর নাম গুরু, সকালে আমাকে আবার ডাবল ডিমের আন্ডা পোচ খাওয়ালো নিজের হাতে বানিয়ে । গত ৩ দিনে আমরা বেশ ভালো সময় কাটেছিলাম । খাবার শেষ করে সাইকেল প্রস্তুত করে ১০ টার দিকে বের হচ্ছি, সে সময় আন্দ্রের কাছে রুমে বিদায় নিতে গেলাম৷ সে উঠে বাইরে চলে আসলো আমাকে বিদায় দিতে, মানুষ টা খুব ভালো।
বিদায় নিয়ে রওনা করলাম আল্লাহর নামে৷ এর আগে কখনো এরকম নেটওয়ার্কের বাহিরে যাইনি । দেশের মধ্যে থাকলে হয়তো এতটা নার্ভাসনেস কাজ করতোনা । কিন্তু দেশের বাহিরে, তাও একা, সেজন্য শুরুতে মনের মধ্যে একটা ভয় ছিলো । নিজেকেই নিজের মন কে শক্ত করতে বলতাম , এতদিন যেহেতু পেরেছি এটাও কোন ব্যাপার না । আপনি নিজেই একবার ভেবে দেখুন … কেমন লাগবে ১০ দিন নেটওয়ার্ক ছাড়া বিছিন্ন হয়ে থাকতে !
সেদিন মারহি তে থাকার প্লান ছিলো , রোথাং পাস এর আগের একটা ছোট যায়গা, এখানে থাকা এবং খাওয়ার জন্য বেশ কয়েকটা ধাবা রয়েছে। মানালী শহর ছেড়ে কিছুক্ষনের মধ্যেই বিখ্যাত মানালী-লেহ এর মূল হাইওয়েতে উঠলাম । মাথার মধ্যে হাজার টা চিন্তা ঘুর ঘুর করছে । কি হবে সামনে ? বিপদ হলে বাসায় কেমনে জানাবো? মরে গেলে কেউ খুঁজে পাবে তো ? ব্লা ব্লা ব্লা… আরও কত কি !!
সত্যি বলতে প্রকৃতির সৌন্দর্যের কাছে এসব তুচ্ছ ভয় ভীতি দৌড়ে পালায় । খুব কম সময়ের মধ্যেই পালছান পৌছাই। বাঁ দিকের রাস্তা চলে গিয়েছে সোলাং ভ্যালীর দিকে, ডানে উপরে উঠে গিয়েছে মারহির দিকে । এরপর থেকেই শুরু হয়ে গেলো প্যাঁচানো প্যাঁচানো রাস্তা । মানালী ছিলো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬৫০০ ফিট উপরে , আর সেদিনের গন্তব্য ছিলো মারহি ১১০০০ ফিট উপরে। অর্থাৎ সারাদিনে ৪৫০০ ফিট উপরে উঠতে হবে মাত্র ৩৫ কি.মি. এর দূরত্বের মধ্যে । সবুজ পাহাড়ের ফাকে ফাকে মেঘের খেলা দেখতে দেখতে ক্লাইম্বিং এর কষ্ট তো দূরে থাকা একবারের জন্য মনেও হয়নি আমার সারা দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে । ফোনের দিকে তাকাতেই দেখি ২ টা সিমের একটাও নেটওয়ার্ক নেই । মজায় মজায় ১ দিকের লুপ গুলো বেশ উপভোগ করতে করতে পেড়িয়ে যাচ্ছিলাম , প্রায় ২৩ কি.মি. শেষ করে গুলাবা নামে একটি যায়গায় ধাবা থেকে নুডলস খেয়ে রেস্ট নিচ্ছিলাম আর উপরের দিকে তাকিয়ে হাসছিলাম ? কিন্তু কেন? দেখছিলাম কিভাবে পেচিয়ে রাস্তা কোথায় উঠে গেছে।
খাবার শেষ করেই আবার এগোতে শুরু করলাম, ৬/৭ টার মত লুপ হবে সম্ভবত। মাঝে মাঝে যখন মোড় গুলো আসছিলো তখনকার সামনের দিকের ভিউ দেখে মনে হচ্ছিলো আমি মেঘের সাথে টেক্কা দিয়ে আগাচ্ছিলাম । মাঝে মাঝে কিছু ব্লাইন্ড কার্ভ গুলো ছিলো বেশ ভয়ানক, মনে হচ্ছে রাস্তা শেষ! খুব সাবধানে এই ব্লাইন্ড জোন গুলো পার হয়েছিলাম। ৫০ মিটার আগেও বোঝা যায় না রাস্তাটি আসলে কোন দিকে গিয়েছে। এরই মধ্যে হুট করেই যদি বিপরীত থেকে গাড়ি চিলে আসে একবারে ধাক্কা খেয়ে ১০ হাজার ফিট নিচে , গুলাবা ক্রস করার পর থেকে রাস্তার পাশের সেইফটি রেলিং গুলো ছিলো না। আসার পথে ছোট/বড় মিলিয়ে প্রচুর ঝর্ণা চোখে পরেছে।
গুলাবার পয়েন্টের পরের লুপ গুলো পার হওয়া অবস্থায়ই দূরে চোখ যায় হঠাৎ, সামনের পাহাড় টা ই মারহি । ওই পাহারের কোল ঘেঁষে সারি বদ্ধ ভাবে একটা রাস্তার উপরে আরো কয়েক টা রাস্তা উঠে যাচ্ছে উপরের দিকে, ওখানেও ৫/৬ টার মত লুপ হবে। গুলাবার লুপ গুলো পার করার পর প্রায় দেড় কি.মি. রাস্তা সোজা আসার পর দেখালাম বেশ কিছু যায়গায় বড় সর ল্যান্ড স্লাইড হয়েছে, দেখেই বুঝতে পারলাম হয়তো কিছুক্ষণ আগেই ল্যান্ড স্লাইড হয়েছে । রাস্তা কিছু যায়গায় বেশিই খারাপ অবস্থা, মারহি পৌছানোর আগের লুপ গুলো শুরু হওয়ার রাস্তা ভেংগে একাকার৷ আসতে ধীরে মাথা ঠান্ডা করে লুপ গুলো পার করেছি। এই পাহাড় এর রাস্তার উপর/সাইডে বিশাল বিশাল আকৃতির পাথড় গুলো দেখে মনে হচ্ছলো এই বুঝি মাথার উপর পড়লো ! একটা পড়লেই ভর্তা হয়ে যাবো নিশ্চিত। কিছু কিছু বড় পাথড় সাপোর্ট দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। এই রাস্তায় আমার থেকেও বেশি কষ্ট হয় ট্রাক ড্রাইভারদের আমি নিশ্চিত, বেচারারা গিয়ার ঠিক সময়ই ফালায় কিন্তু ফস ফস করতে থাকে ট্রাকের ইঞ্জিন গুলো মনে হয় আর উঠতে পারে না, কি যে কষ্ট !
এই সিজনে এই রাস্তা বেশ ব্যস্ত থাকে ট্যুরিস্টদের গাড়ি আর লাখ লাখ মটরবাইকের দের ভিড়ে! মটরবাইকার পাশ দিয়ে যায় আর বুড়ো আংগুল দেখায়, কিছু কিছু ট্যুরিস্ট গাড়ি চালিয়ে পারলে আমার গায়ের উপর দিয়ে উঠিয়ে সেলফি তুলে ! যাই হোক বেশ উপভোগ করেই আপহিল গুলো শেষ করেছি কোন কষ্ট ছাড়াই৷ সকাল সকাল বের হলে হয়তো আজকে রোথাং পাস সামিট করে খোকসার পৌছে যেতাম । বেশি বুঝতে গেলে ধরা খাইতে হয়, তাই প্লানিং অনুযায়ী ই চলা বুদ্ধিমানের কাজ। এজন্যই তো আমি আজকে মারহি থেকে গেলাম। মারহি পৌছে একটা রুমের বেড ম্যানেজ হয়ে গেলো কম খরচায় । আমি উঠতে না উঠতেই চারিদিক কুয়াশায় অন্ধকার হয়ে গেলো । সাজেক সাজেক লাগছিলো এক পর্যায়ে এখানের ভিউ টা দেখতে, বইলেন না আবার কিসের মধ্যে কি পান্তা ভাতে ঘি। আমাদের সাজেক আসলেই বেশ সুন্দর । ধাবার মালিককে দেখলাম কার সাথে যেনো ফোনে কথা বলতেছে, দেখেই সাথে সাথে জিজ্ঞাসা করলাম নেটওয়ার্ক পেলো কিভাবে ? উনি বললো গতকাল এখানে জিও এর সিম দিয়ে গিয়েছে কোম্পানির লোক । আমার কাছে তো এয়ারটেল আর ভোডাফোন সিম , সুতরাং নেটওয়ার্ক একদম নেই । তবে কেউ বললো উপরের মন্দিরে উঠলে নেট পাবো ।উঠেই দেখি আকাশ প্রচণ্ড কালো , কিসের আর কি… আবহাওয়া খারাপ হয়ে গেলো হুট করেই, এমন সময়ে ঝুম বৃষ্টি নামলো ।
সাইকেল ঢেকে রুমে গিয়ে জামা কাপড় বদলিয়ে ভারী কাপড় পড়ে নিলাম । বাইরে এসে দেখে বৃষ্টি কমেছে কিছুটা। আমি যে ধাবায় উঠেছি এখানে কিছু খাবার অর্ডার দিতেই আবার বৃষ্টি শুরু । তাই খাবারের সাথে অর্ডার দিয়ে দিলাম। গরম চায়ের ধোয়া সাথে চারিদিক কুয়াশা + মেঘের ঘনঘটা, সাথে ঝুম বৃষ্টি , সব মিলিয়ে রেসিপি টা সেই ছিলো বিকাল এর । বৃষ্টি কমার পর আবার নেটওয়ার্ক খোজার জন্য একটি মন্দিরের উপরে উঠলাম কিন্তু পেলাম না! পরে এক ভাইয়ের থেকে হটস্পট নিয়ে দেশে খবর পৌঁছালাম। সেই রাতে তাপমাত্রা ২-৩ ডিগ্রি তে উঠানামা করছিলো, রোথাং পাসের আসা পাশের আবহাওয়া বেশির ভাগ সময় একরকম খারাপই থাকে বেশির ভাগ সময় ।
#1971miles #ladakh #coxsbazar #khardungla #seatosummit #epicadventure #bangladesh