সুন্দরবন!!!
গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর-এ ঘুরে এলাম সুন্দরবন থেকে। আমার অফিসের কয়েকজন সহকর্মী ও তাদের পরিবারের সাথে ঘুরতে গিয়েছিলাম বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন “সুন্দরবন”-এ।
প্রথমেই সুন্দরবন সম্পর্কে কিছু বর্ণনা দেয়া যাক-
সুন্দরবন হলো বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রশস্ত বনভূমি যা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলীর অন্যতম। গঙ্গা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকার বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই অপরূপ বনভূমি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দুই জেলা উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জুড়ে বিস্তৃত। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি। ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশে এবং বাকি অংশ রয়েছে ভারতের মধ্যে।
তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবন ৬ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এর বাংলাদেশ ও ভারতীয় অংশ বস্তুত একই নিরবচ্ছিন্ন ভূমিখণ্ডের সন্নিহিত অংশ হলেও ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় ভিন্ন ভিন্ন নামে সূচিবদ্ধ হয়েছে; যথাক্রমে “সুন্দরবন” ও “সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান” নামে। সুন্দরবনে জালের মত ছড়িয়ে আছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ক্ষুদ্রায়তন দ্বীপমালা। মোট বনভূমির ৩১.১ শতাংশ, অর্থাৎ ১,৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদীনালা, খাঁড়ি, বিল মিলিয়ে জলাকীর্ণ অঞ্চল। বনভূমিটি, স্বনামে বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানান ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। জরিপ মোতাবেক ১০৬ বাঘ ও ১০০০০০ থেকে ১৫০০০০ চিত্রা হরিণ রয়েছে এখন সুন্দরবন এলাকায়। ১৯৯২ সালের ২১শে মে সুন্দরবন রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
নামকরণঃ
বাংলায় সুন্দরবন-এর আক্ষরিক অর্থ সুন্দর জঙ্গল বা সুন্দর বনভূমি। সুন্দরী গাছ থেকে সুন্দরবনের নামকরণ হয়ে থাকতে পারে, যা সেখানে প্রচুর জন্মায়। অন্যান্য সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এরকম হতে পারে যে, এর নামকরণ হয়তো হয়েছে “সমুদ্র বন” বা “চন্দ্র-বান্ধে (বাঁধে)” (প্রাচীন আদিবাসী) থেকে। তবে সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয় যে সুন্দরী গাছ থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে।
আমার চোখে সুন্দরবন:
আমরা ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখ রাতে বাসে যাত্রা শুরু করি। কুয়াশা বেশি থাকায় আমাদের ফেরি সময়মত নদী না পাড় করায় আমরা পরের দিন একটু দেরিতেই খুলনায় পৌঁছাই। এরপর আমরা সবাই মংলা পোর্টে পোঁছাই। ওখানেই আমাদের ছোট্ট শীপ আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলো। দুপুরের মধ্যেই আমরা শীপে উঠে যাই এবং সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রার শুরু আমাদের এখান থেকেই। পরবর্তী ৩ দিন এই শীপেই আমাদের সবার দিন কাটবে, ভেবেই আমরা সবাই তখন খুশিতে আত্নহারা।
মংলা পোর্ট থেকে যাত্রা শুরু করার কিছুক্ষণ পর থেকেই শুরু হওয়া বন ৩ দিন ধরে শুধু দেখেই গেছি। যত দেখছি, তত অবাক হয়ছি। কত্তোবড়…!!! কখনও একপাশে, কখনও দুইপাশে… শেষই হয় না।মনে হচ্ছিলো, এর কোন শেষ নেই!
এই ৩ দিনের ট্যুরে আমরা যেসব স্পট কভার করেছি, সেগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিচে দেওয়ার চেষ্টা করছিঃ
১। হাড়বাড়িয়া ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্রঃ এ জায়গাটি আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। এ জায়গাটি মংলা পোর্ট থেকে বেশ কাছে। আমার মনে হয়েছে এ জায়গাটিতে ঘুরে আসলেই সুন্দরবনের বেশ গভীর পর্যন্ত ধারণা হয়ে যায়। পার্কটিতে ঢুকে কিছু দূর হাটার পরই সুন্দরবনের আসল সৌন্দর্য চোখে পড়বে। একটা লেক আছে এখানে। লেকের মধ্যে অনেক অনেক শাপলা ফুটে আছে। তাছাড়া, সুন্দরী গাছ, গাছের শিকড়, ভাটার টানে শুকিয়ে যাওয়া ছোট ছোট খাল, অনেক অনেক নাম না জানা গাছ, গোলপাতা, বানর, হরিণ চোখে পড়বে এখানে।
২। দুবলার চরঃ দুবলার চর-কে একনামে শুটকির রাজত্ব বলা যেতে পারে। খুব সকালে গিয়েছিলাম আমরা এখানে। এতো সকালেও অনেক জেলেদের আনাগোনা লক্ষ্য করার মত ছিল। কেউ মাছ ধরে নৌকা নিয়ে ফিরেছে, মাছের ঝুড়ি নামাচ্ছে, কেউ মাছ পরিষ্কার করছে, কেউ বা মাছ আলাদা করছে, কেউ কেউ শুটকি বানানোর ব্যবস্থা করছে।
পুরো চর ঘুরে আমার মনে হয়েছে, কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতের সাথে এই চরের সাদৃশ্যতা অনেক। আমার পুরা সময়টাই মনে হয়েছে আমি কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে আছি। খুবল খুবই সুন্দর, যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। একই সাথে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্যতা, মাঝিদের জীবন-যাপন সবই দেখে ফেলা সম্ভব এখানে।
৩। কটকা সমুদ্র সৈকতঃ সুন্দরবনের দক্ষিণ পূর্বকোণে অবস্থিত এই সমুদ্র সৈকত সুন্দরবনের আকর্ষণীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। কটকা মংলা বন্দর থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানেই সুন্দরবনের আসল আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দেখা মেলে। এ জায়গাটি যেমন ঝুকিপূর্ণ, তেমনি সুন্দরও। বাঘ ছাড়াও এখানে চিত্রা হরিণের দল, বিভিন্ন জাতের পাখি, বানর দেখা যায়। আমাদেরও দেখা হয়েছিল চিত্রা হরিণের দলের সাথে। এজায়গাটিও আমার কাছে খুব সুন্দর লেগেছে।
সময় স্বল্পতার কারণে এখানের আর একটি স্পট আমরা মিস করেছি, জামতলা সমুদ্র সৈকত। শুনেছি এজায়গাটিও অনেক সুন্দর। অন্য কোনদিন আবার যাওয়া হবে ইনশাল্লাহ।
৪। করমজল পর্যটন কেন্দ্রঃ এ জায়গাটি আমার সব থেকে খারাপ লেগেছে। বেশির ভাগ মানুষই এজায়গাটিতে ঘুরতে যায়। মানে, বেশিরভাগ মানুষ সুন্দরবন বলতে এজায়গাটিকেই বুঝে। এখানে একটা ছোট চিড়িয়াখানা আছে, যেখানে মেইনলি কুমিরের প্রজনন ও সংরক্ষণ কেন্দ্র হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। কুমির ছাড়াও এখানে হরিণের দেখাও মিলে। জায়গাটি অনেক দর্শনার্থী আসে প্রতিদিন, যার বেশিরভাগই ভারতীয় বলে মনে হলো আমার।
এভাবেই শেষ হয়েছিল আমাদের সুন্দরবন ঘুরা। অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল এখানে যাওয়ার। সে ইচ্ছা পূরণ হলো এভাবেই। সাথে আর এক লোকাল গাইড শাওনও ছিল। এছাড়া, সহকর্মী রা ছাড়াও তাদের পরিবার পরিজনদের সাথে আলাদা ভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তারা ছাড়াও আরো কিছু ভালো মানুষের সাথে পরিচয় হওয়ার সুযোগ হয়েছিল।
আমাদের ট্যুরটি সফল হতে সাহায্য করেছে ট্যুরবাজ নামক একটি ট্রাভেল গ্রুপ। তারাই এই পুরো ট্যুরের ব্যবস্থা দেখ-ভাল করেছিলেন। আমাদের দিক থেকে প্রতিনিধিত্ব করেছিল শাওন। এজন্য আলাদা ভাবে শাওনকে কখনও ধন্যবাদ দেওয়া হয় নাই। তাই এখানেই দিয়ে দিলাম। ধন্যবাদ, শাওন!
আমাদের পুরো ট্রিপে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা খুবই ভালো ছিল। আমাদের শীপের বাবুর্চি সাত্তার ভাই-এর হাতে যেন জাদু আছে। যাই রান্না করছে, তাই-ই মজা করে খাইছি আমরা সবাই।
এবার আসি খরচের আলোচনায়। আমরা যেহেতু একটি গ্রুপের মাধ্যমে গিয়েছিলাম, তাই আমাদের জনপ্রতি খরচ হয়েছিল, ১০০০০-এর মত। আমার নিজের মতে, ১০০০০-১৫০০০ টাকার মধ্যেই খুব ভালো ভাবে সুন্দরবন ঘুরে আসা সম্ভব।
আজ এখানেই শেষ করছি। অন্য কোনদিন অন্য কোন গল্প নিয়ে আসবো।


















