ঢাকায় থাকি অনেক বছর হয়ে গেছে। যাই যাই করে কখনো আহসান মঞ্জিল যাওয়া হয় নাই। ঐতিহাসিক ওই প্রাসাদে যাওয়াটা এতদিন শুধু পরিকল্পনায় সীমাবদ্ধ ছিল। আর শুধু আফসোস করতম ইস কবে যে এই সুন্দর স্থাপনাটি নিজের চোখে দেখতে পাব! অবশেষে সেই সুযোগ বা মহেন্দ্রক্ষন, যাই বলি না কেন, এনে দেন আমাদের সবার প্রিয় লোকাল গাইড @AbdusSattar ভাই। উনি আহসান মঞ্জিল ও আশেপাশের এলাকা নিয়ে একটি সুন্দর মিটাপের ঘোষণা দেন।১২৫তম এই মিটাপের ঘোষণা দেখে ১ মিনিটেরও কম সময় নেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে। দিন-তারিখ, জায়গা, হোস্ট আর আগ্রহ এ সবকিছু ঠিক থাকলে আসলে কারোরই এক মিনিটের বেশি সময় লাগার কথা না সিদ্ধান্ত নিতে।
ক্যালেন্ডারের পাতায় চোখ রাখতে রাখতে একদিন ২৫ডিসেম্বর হাজির।অপেক্ষার পালা শেষ। আগের দিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী সকাল্ থেকে হাত চালিয়ে দিনের সকল কাজ গুছিয়ে ফেলি দুপুরের খাবারের আগেই। এরপর যাত্রা শুরু পুরান ঢাকার উদ্দেশ্যে, গন্তব্য আহাসান মঞ্জিল, হৃদয়ে ১২৫তম মিটাপ। মিটাপে পৌঁছানো এবং সময়মত মিটাপ শুরু করতে আমাদের সামনে দুইটা বাধা ছিল। প্রথমত পুরান ঢাকার অলঙ্ঘনীয় জ্যাম আর দ্বিতীয়ত শীতের সংক্ষিপ্ত দিন। দুই ঘণ্টা সময় নিয়ে বের হওয়ার পরও ছুটির দিনে আহসান মঞ্জিল পৌছাতে ৫ মিনিট দেরি হয়েছিল আমার। অবশ্য আমার পরেও বেশ কয়েকজন এসেছে। বড়দিনের ছুটি থাকায় আহসান মঞ্জিল বন্ধ ছিল ওই দিন। তাই দীর্ঘ দিনের ইচ্ছাকে অপূর্ণ রেখেই আমার মিটাপ শুরু করতে হয়েছিল সেদিন। হয়ত আরেকদিন যেতে হবে, আহসান মঞ্জিল দেখার সাধ পূর্ণ করার জন্য। তবে গেটের বাইরে থেকে যতটুকু দেখতে পেরেছি সেটুকুও কম না।
হোস্ট সাত্তার ভাই আর @MahabubMunna ভাই সমস্ত প্ল্যান আমাদেরকে বুঝিয়ে দিলেন। কীভাবে কোথা থেকে শুরু করব এবং কোথায় গিয়ে শেষ হবে ১২৫তম মিটাপ। মাহাবুব ভাই পুরোটা সময় পুরান ঢাকার বিভিন্ন তথ্য আমাদেরকে দিয়ে গেছেন ননস্টপ, যা আমাদের কাছে অজানা ছিল এতদিন। প্রথমেই আমরা সিন্ডিকেট মার্কেট সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য এবং বেশ কিছু ছবি নেই। পাশাপাশি গুলশান আরা সিটি সম্পর্কেও তথ্য ও ছবি নেই। আসলেই পুরান ঢাকার প্রতিটা ইটের মধ্যেই লুকিয়ে আছে নানান তথ্য আর ইতিহাস স্থানীয়রা যা অনেক ভালো এবং বেশি জানে। এরপর আমরা যাই বুলবুল ললিত কলা একাডেমীতে । এখানে আমরা বেশ কিছু সময় নিয়ে বিভিন্ন রুম পরিদর্শন করি এবং ছবি তুলি। বুলবুল ললিত কলাতে ঢোকার আগে আমরা আশেপাশের বেশ কিছু দোকান ও রেস্টুরেন্টের তথ্য ম্যাপে যোগ করি এবং কিছু দোকানের তথ্য এডিট করি। এরপর আমরা যাত্রা শুরু করি ব্যাটারি গলি তথা ওয়াইজঘাট রোড দিয়ে। এখান থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পাইকারি হিসেবে বিভিন্ন ব্যাটারি সরবরাহ করা হয়। ব্যাটারি গলি পার হয়ে আমরা হাটা শুরু করি ইসলামপুর রোড দিয়ে। ব্যাটারি গলির মাথায় ইসলামপুর রোডের এই পাশে রয়েছে ঘড়ির বিশাল মার্কেট। অসংখ্য ঘড়ির দোকান রয়েছে এখানে যারা মেইড ইন জিঞ্জিরা থেকে শুরু করে মেইড ইন সুইজারল্যান্ডের ঘড়ি পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করে। এই রাস্তার দুই পাশের বিভিন্ন দোকানের তথ্য আমরা ম্যাপে আপডেট করি এবং ছবি সংযুক্ত করি।
ইসলামপুর রোডের পর আমাদের পরবর্তী গন্তব্য বিউটি বোর্ডিঙে যাওয়ায় জন্য আমরা বাংলাবাজার রোড দিয়ে হাটা ও তথ্য সংগ্রহ এবং আপডেট করতে থাকি। এই রোডে অনেক গুলো বইয়ের দোকান আছে যারা পুরাতন বই বিক্রি করে। আমি আগে জানতাম নীলক্ষেত এবং মিরপুর ১০ নম্বর গোল চক্করেই কেবল পুরাতন বই বিক্রি হয়। কিন্ত এখানে এসে আমার নিজের তথ্য ভান্ডারকেও আপডেট করলাম। আজাদ প্রোডাক্টস, আইডিয়াল প্রোডাক্টস, লোকনাথ দিন পঞ্জি সহ অনেক প্রকাশনী সংস্থার দোকান রয়েছে এই রোডে। এই দোকানগুলোর অপর পাশে বিশাল জায়গা দখল করে দাড়িয়ে আছে বাংলাদেশের পুরাতন পোষ্ট অফিস ঢাকা সদর পোষ্ট অফিস । মাহাবুব ভাই এই পোষ্ট অফিস সম্পর্কে আমাদের অনেক তথ্য দিলেন। আমরা সবাই এখানে বেশ কিছু ছবি তুলি এবং তারপর বিউটি বোর্ডিঙের উদ্দেশ্যে হাটতে থাকি। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা ঐতিহাসিক বিঊটি বোর্ডিঙে হাজির হই। এই সেই বিউটি বোর্ডিং যেখানে বাংলার অনেক মেধাবী সাহিত্যিকরা নিয়মিত আসতেন আর কালি কলমে সৃষ্টি করতেন একেকটা মাস্টারপিছ। আমরা এখানে বেশ কিছু সময় নিয়ে বোর্ডিঙের ভিতর বাহিরের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখি আর ছবি তুলি। বিউটি বোর্ডিং নিয়ে আমাদের অনেক কিছু জানা হয় এদিন। এখানে থাকার জন্য রুম ভাড়া পাওয়া যায় এখনো এবং খাওয়ারও সুব্যাবস্থা আছে। তবে অবশ্যই আগে থেকে কন্টাক্ট করে যেতে হবে। বিশেষ দিনগুলোতে রুম ভাড়া না পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এখানে একটি রেস্টুরেন্টও আছে। ইচ্ছা করলে আপনিও এর মুখরোচক খাবারের স্বাদ নিতে পারেন। বিউটি বোর্ডিং দেখার মধ্য দিয়ে আমাদের মিটাপের বাইরের কাজ শেষ। এবার ভিতরের কাজ (খানা পিনা) শুরু করতে হবে তাই পরবর্তী গন্তব্য বিউটি লাচ্ছি-ফালুদার দোকান।
বিউটি লাচ্ছি-ফালুদাতে সবাই পেট ভরে গরম পুড়ি খেলাম। ধনে পাতার সসের সাথে গরম পুড়ি- শীতের সন্ধ্যায় এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না। এখানে যাওয়ার আগেই নিয়ত করেছিলাম একটার বেশি পুড়ি খাব না কিন্ত শেষে দেখা গেল বড় সাইজের ৩টা শেষ করে বসে আছি ৪ নাম্বারটার জন্য। অবশ্য জিভে লাগাম দিয়ে তিনেই ইনিংস শেষ করে মনের আর মুখের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বিউটির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসি। না হলে আরো ৪-৫টা পুড়ি খুন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এই সেশনে মাহাবুব ভাই গুগল ম্যাপ এবং লোকাল গাইড কানেক্ট নিয়ে আমাদের বেশ কিছু তথ্য দেন। কিছু প্রশ্নের উত্তরও দেন তিনি। পুড়ির পাশাপাশি কেউ কেউ এখানকার স্পেস্পাল ফালুদার স্বাদও নেন। এখান থেকে বের হয়ে আমরা রাস্তার অপর পাশে স্টার কাবাবে যাই চা পর্ব সারার জন্য। এখানেও বড় একটি সেশন জুড়ে ছিল প্রশ্নোত্ত্র। তাছাড়া গুগল এপস লগার এপটি কেন ও কীভাবে ব্যাবহার করতে হয় সে বিষয়ে মাহাবুব ভাই হাতে কলমে বিষয়টি সবাইকে দেখান। এবার ফেরার পালা। কিন্ত কারোরই যেন যেতে মন চাচ্ছিল না। বিউটি লাচ্ছি আর স্টারে এক ঘণ্টার বেশি সময় পার করেও রাস্তায় দাড়িয়ে আরো এক ঘন্টার আলাপ চলে। অবশেষে সন্ধ্যা ৬টায় যে মিটাপ শেষ হওয়ার কথা ছিল তা শেষ হয় রাত ৯টায়। শীত না থাকলে হয়ত রাত ১০টা সাড়ে দশটা পর্যন্ত চলত।
এই মিটাপের আরো কিছু তথ্য এবং ছবি পাবেন সাত্তার ভাইয়ের এই পোষ্টে এবং @Sagir_Ahmmed ভাইয়ের এই পোষ্টে।