ভ্রমন স্থানঃ
১ম দিন - মিলনছড়ি ভিউপয়েন্ট, শৈল্যপ্রপাত, চিম্বুক পাহাড়, নীলগিরি, থানচী, তিন্দু, রেমাক্রী
২য় দিন - রেমাক্রী খাল, নাফাখুম, জিনাপাড়া
৩য় দিন - দেবতা পাহাড়, আমিয়াখুম, ভেলাখুম, নাইক্ষংমুখ
৪র্থ দিন - জিনাপাড়া থেকে নাফাখুম, রেমাক্রী, থানচী হয়ে বান্দরবান শহরে ফিরে আসা
সময়ঃ ৪ দিন, ৫ রাত্র (১২ তারিখ রাত্রে রওনা দিয়ে ১৭ তারিখ সকালে ঢাকায় উপস্থিত থাকা)
শুরুতেই বড় লেখার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি কিন্তু যারা আমিয়াখুম, নাফাখুম যাওয়ার প্ল্যান করছেন তাদের জন্য পোষ্টটি গুরুত্বপূর্ন।
যাওয়ার প্রায় ১০ দিন আগে গাইড ঠিক করার সিদ্ধান্ত হল। দায়িত্ব পড়ল আমার উপর। গাইড ছিল এ ট্যুরের সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়। প্রথমে জয় নামে একটা গাইডকে ঠিক করা হল ৫০০০ টাকায় যার খাওয়ার খরচ আমরা বহন করব এবং ভেলাখুম ভেলা খরচ ও আমিয়াখুম যাওয়ার লোকাল গাইডে খরচ গাইড দিবে।
আমিয়াখুম ট্যুরের রুট দুটো। প্রথমটি হচ্ছে থানচী > পদ্মঝিরি > জিনাপাড়া/থুইসাপাড়া > আমিয়াখুম > জিনাপাড়া/থুইসাপাড়া > নাফাখুম > রেমাক্রী > থানচী। এ পথে গেলে তিন দিনে সব জায়গা কাভার করা সম্ভব কিন্তু ট্যুরের প্রথম দিন পদ্মঝিরি হতে জিনাপাড়া/থুইসাপাড়া যেতে আপনাকে প্রায় ৬-৮ ঘন্টা হাটা লাগবে। আরেকটি রুট হচ্ছে থানচী > রেমাক্রী > নাফাখুম > জিনাপাড়া/থুইসাপাড়া > আমিয়াখুম > জিনাপাড়া/থুইসাপাড়া > পদ্মঝিরি > থানচী। এ পথে সব স্পট কাভার করতে চার দিন লাগলেও কিছুটা রিলাক্সট্যুর দেয়া সম্ভব। গ্রুপে দুজন মেয়ে সদস্য থাকায় এবং বেশিরভাগ সদস্যই ৯ম শ্রেনী, ইন্টারে পড়ায় দ্বিতীয় রুটটাই বেছে নিলাম।
সবাই ট্যুরের একসপ্তাহ আগে একসাথে সায়দাবাদ বাস কাউন্টার থেকে শ্যামলীর টিকিট কাটলাম। যাওয়ার দুদিন আগে প্রয়োজনীয় ঔষুধ, স্যালাইন, শুকনো খাবার, খেজুর, কিসমিস কিনে নিলাম।
দিন ০০ঃ (১২ অক্টোবর, ২০১৯)
আমাদের বাস ছাড়ার সময় ছিল রাত্র ১১.১৫ মিনিট সবাই প্রায় ৩০ মিনিট আগেই কাউন্টারে উপস্থিত ছিলাম। ১১.৩০ এর মধ্যে আমাদের বাস কাউন্টারে চলে এলো। দাউদকান্দিতে জ্যামে না পড়ার দোয়া করে সবাই বাসে উঠলাম এবং যাত্রা শুরু হল। কুমিল্লায় যখন আমাদের বাস যাত্রা বিরতি দিল তখন ছোটন কাকুর তীব্র শীতের কারনে দাড়াতে না পারা লাইনটির মর্ম বুঝতে পারলাম।
দিন ০১ঃ (১৩ অক্টোবর, ২০১৯)
সকালে খুব ভোরে যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন দেখতে পেলাম রাস্তার একপাশে পাহাড় আরেক পাশে খাদ। বুঝতে পারলাম বান্দরবানে শহর আর বেশি দূরে নয়। পাহাড়ী রাস্তার সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে সকাল ৭.৩০ এর দিকে বান্দরবান শহরে পৌছে গেলাম। বাস থেকে নেমে ফেরার টিকিট কাটার জন্য গিয়ে দেখি সব কাউন্টার বন্ধ শুধু শ্যামলীর দুটো কাউন্টার খোলা। কাউন্টারে যাওয়ার পর শুনতে পারলাম টিকিট শেষ কিন্তু অতিরিক্ত একটা গাড়ী ছাড়বে যেটার টিকিট ৭২০ করে নেয়া হচ্ছে। অন্য কোন অপশন না থাকায় ১০০ করে বেশি দিয়েই ফেরার টিকিট কনর্ফাম করলাম। ট্যুর শুরু হল অতিরিক্ত খরচ দিয়ে। কাউন্টারেই সবাই ফ্রেশ হতে লাগলাম। এর মধ্যে আমরা ২-৩ জন চান্দের গাড়ী ঠিক করতে গেলাম। দামাদামির পর একটা চান্দের গাড়ী ঠিক হল ৬০০০ টাকায় কিন্তু শর্ত ছিল দুটো, প্রথমটি হচ্ছে যাওয়ার সময় মিলনছড়ি ভিউ পয়েন্ট, শৈল্য প্রপাত, চিম্বুক পাহাড় ও নীলগিরি দেখিয়ে নিতে হবে এবং দ্বিতীয়টি ছিল নীলগিরিতে চান্দের গাড়ীর পাকিং চার্জ ৩০০ টাকা ড্রাইবার দিবে। ওকেশন না থাকলে ৫০০০ টাকায় চান্দের গাড়ী পাওয়া সম্ভব। চান্দের গাড়ী ঠিক করে সবাই কাউন্টারের পাশেই একটা হোটেলে নাস্তা সেরে নিলাম। নাস্তা শেষ করে সবাই চান্দের গাড়ীতে উঠে পড়লাম। লাইফে প্রথমবার চান্দের গাড়ীতে উঠার সুযোগ হল এ ট্যুরে যদিও ছাদে উঠার ব্যাবস্থা না থাকায় কিছুটা বিরক্ত ছিলাম। ১০ মিনিট যাওয়ার পর মিলনছড়ি ভিউ পয়েন্টে পৌছে গেলাম। এটা কোন স্পট না রাস্তার পাশেই একটা খালি জায়গা যেখান থেকে পাহাড়ের সুন্দর একটা ভিউ পাওয়া যায় মাত্র কিন্তু গাড়ী থামিয়ে ছবি তোলার জন্য যথেষ্ট সুন্দর। এখানে ১০ মিনিট সময় ব্যায় করে আমরা আবার চান্দের গাড়ীতে উঠলাম। প্রায় ৩০ মিনিট গাড়ী চালানোর পর ড্রাইভার যেখানে থামাল সে জায়গাটার নাম শৈল্য প্রপাত। পাহাড়ের ঢাল দিয়ে পানির ফ্লো। এখানেও পাহাড়ের সুন্দর কিছু ভিউ পাওয়া যায়। পানি কম থাকায় সৌন্দয্যের অধের্কও পেলাম না। যে যায়গা দিয়ে পানি নামছে তা পার হয়ে ওপারে পাহাড়ের উপরে কিছুদূর যাওয়া যেত কিন্তু আমরা সময় নষ্ট না করে আবার যাত্রা শুরু করি। এবার গন্তব্য চিম্বুক পাহাড়। প্রায় ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা পর আমরা পৌছে গেলাম চিম্বুক পাহাড়ের গেটে। ২০ টাকা মূল্যের টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকার পর কিছুটা হাটলেই মূল স্পট। চিম্বুকের চূড়ায় দাড়িয়ে যত দূর চোখ যায় শুধু পাহাড় দেখা যায়। এ ভিউটা সত্যিই অসাধারন। বেশ কিছুক্ষন সেখানে সময় কাটিয়ে, ছবি তোরার পর আমরা চান্দের গাড়ীতে উঠে পড়লাম। এবার এ রুটের শেষ স্পট নীলগিরিতে যাওয়ার পালা। নীলগিরি পৌছানোর আগেই একটা পুলিশ ক্যাম্প পড়ে যেখানে গ্রুপের ১ জনের নাম, ঠিকানা এন্ট্রি করা লাগে এবং সবার ব্যাগ চেক করা হয়। চেকিং এর পর আবার যাত্রা শুরু। চিম্বুক থেকে নীলগিরিতে পৌছাতে প্রায় ১.০০ ঘন্টার কিছু বেশি সময় লাগল। ৬০ টাকার টিকিট কেটে সবাই ভিতরে ঢুকে গেলাম। নীলগিরি এবং চিম্বুক প্রায় একই ধরনের জায়গা কিন্তু নীলগিরি স্পটটা চিম্বুকের তুলানায় বড় এবং সাজানো গোছানো। যেদিকেই তাকাবেন ইনফিনিটি ভিই পাবেন এবং আকাশের সাথে পাহাড়ের সম্পর্কটা আরেকটু কাছে থেকে উপলব্ধি করা যায়। নীলগিরির হ্যালিপ্যাডটা দারুন জায়গা। নীলগিরি ঘুরার পারফেক্ট সময় সকাল ও বিকাল। এখানে হ্যালিপ্যাডে কাটানো একটি বিকেল হতে পারে আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ বিকেল। এখানে কিছু কটেজ দেখতে পেলাম। কটেজ ভাড়া জানার ইচ্ছাও হয়নি, বুঝতে পারছিলাম এখানে এক রাত্রের কটেজ ভাড়া দিয়ে আমার বগালেক, কেওক্রাডং ট্যুর হয়ে যাবে। হাতে সময় কম থাকায় এবং মাথার উপর রোদের তীব্রতা বেশি থাকায় কোথাও বসে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারিনি। আরেকবার আসার ইচ্ছা নিয়ে নীলগিরি থেকে বের হলাম। নীলগিরির বাহিরে রোডের অপর পাশে পাহাড়ীদের দোকান থেকে পেপে খাওয়ার পর যখন চান্দের গাড়ীতে উঠলাম তখন বুঝতে পারলাম আমাদের গ্রুপের সবথেকে সিনিয়র সদস্য ইরফাত ভাই মিসিং। তাকে খুজতে গিয়ে আরেকবার নীলগিরিতে ঢুকতে হল। বুঝিনি আল্লাহ আমার আরেকবার নীলগিরি ঘুরার ইচ্ছাটা এতদ্রুত কবুল করে নিবেন। সব জায়গা খুজার পর ক্যান্টিনের পাশে যখন ইরফাত ভাইকে দেখতে পেলাম তখন উনি কোন এক রমনীর সাথে আড্ডায় ব্যস্ত। তাকে টেনে নিয়ে চান্দের গাড়ীতে উঠালাম। উচু নিচু পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দুপাশের সৌন্দর্য্য আপনাকে বিমোহিত করবে। অসম্ভব সুন্দর পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে প্রায় ১.৩০ ঘন্টার মত চলার পর আমরা যখন থানচীতে পৌছাই তখন ঘড়িতে দুপুর দুইটা বাজে। থানচী যাওয়ার আগে বলিপাড়া নামক জায়গায় পুলিশ চেকপোষ্ট আরেকবার সবার নাম, ঠিকানা এন্ট্রি করা লাগে। থানচী নামার পর ঢাকা থেকে ঠিক করে রাখা গাইড মার্টিন ত্রিপুরা আমাদের রিসিভ করল। প্রথমেই সে আমাদের সাঙ্গু নদীর পাশে একটা ঘর+রেষ্টুরেন্টে নিয়ে গেল যেখানে সবাইকে দুটো ফর্ম দেওয়া হল একই ইনফরমেশন লেখার জন্য একটা যাবে পুলিশের কাছে আরেকটা বিজিবির কাছে। ইনফরমেশন লেখার সময়ই আমরা আমাদের দুপুরের খাবার অর্ডার দিয়ে দিলাম পাশের রেষ্টুরেন্টে। ভাত, মুরগী, ডাল, আলুভর্ত্তার ১০০ টাকার প্যাকেজ। ফর্ম ফিলাপ হলে আমরা গাইড সহ পুলিশ ফাড়িতে যাচ্ছিলাম ফর্ম জমা দেয়ার জন্য। পুলিশ ফাড়িতে ঢুকার আমরা গাইডের আরেক নতুন রূপ দেখতে পেলাম। সে আমদের জানিয়ে দিল তার চার্জ ৫০০০ টাকা ঠিক আছে কিন্তু বোট ভাড়া নৌকা প্রতি ৪৫০০ টাকার কম হলে সে যাবে না। বেশ কিছুক্ষন তর্ক করার পর আমরা যখন বোট মালিকদের সাথে কথা বলতে চাইলাম তখন সে ফোন দিয়ে নিজে কিছুক্ষন মাঝিদের সাথে অধিবাসী ভাষায় কথা বলে আমাকে ফোন দেয়। অনেকক্ষন দামাদামি ও অন্য বোট রেডি আছে এই হুমকি দেয়ার পর ৪০০০ টাকায় রাজী করাই কিন্তু ২ মিনিট পর গাইড আবার মাঝিকে ফোন দিয়ে কিছুক্ষন ওদের ভাষায় কথা বলে আবার আমাকে মাঝির সাথে কথা বলার জন্য ফোন ধরিয়ে দেয়। এবার মাঝি এক বেলা ভাত খাওয়ার জন্য বোট প্রতি ১০০ করে মোট ৩০০ টাকা এক্সটা দাবি করে। সময়ের কথা চিন্তা করে ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৪১০০ টাকা করেই বোট ফইনাল করলাম। এবার বিপত্তি ঘটল পুলিশ ক্যাম্পে। গ্রুপে কয়েকজন ঠিকানায় বাড়ি নং, রোড নং, গ্রাম, থানা উল্লেখ না করায় সবাইকে দিয়ে আবার ফর্ম ফিলাপ করাল। ক্যাম্পে কাজ শেষ করে খুব দ্রুত দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। যাদের ট্রেকিং জুতা ছিল না তারা থানচী বাজার থেকেই ট্রেকিং জুতা কিনে নিল। সবাই লাইফ জ্যাকেট ভাড়া নিয়ে বোটে উঠে পড়লাম। লাইফ জ্যাকেট বাধতামূলক যেটা ছাড়া বোট ছাড়বে না। সাঙ্গু নদী ধরে কিছুদূর যাওয়ার পর মনে হচ্ছিল এক অন্য পৃথিবীতে ঢুকে যাচ্ছিলাম। দুপাশে উচু উচু পাহাড় ও তার মাঝে অধিবাসীদের ঘর গুলোর সৌন্দর্য্য অবাক হয়ে দেখতে থাকলাম। সাঙ্গু নদী দিয়ে আমাদের বোট যতই ভিতরে যাচ্ছিল পানিতে পাথরের পরিমান ততই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। নদী, নদীর উপর বড় ছোট পাথর, দুপাশের পাহাড় ও অধীবাসীদের জীবনযাত্রা সব মিলে যে পরিবেশটা দেখেছিলাম তা লিখে বর্ননা করা সম্ভব না। যদি কেউ নাফাখুম ও আমিয়াখুম নাও যেতে চান তারা শুধু থানচী থেকে রেমাক্রী এই বোট জার্নিটা করতে পারেন। আমার কাছে সাঙ্গুনদীকে মনে হয়েছে বাংলাদেশের সবথেকে সুন্দর নদীপথ। বোট চলার প্রায় ১ ঘন্টা মাঝেই পৌছে গেলাম তিন্দু। তিন্দুর পর দেখা পেলাম রাজা পাথরের যেটা পাহাড়িদের কাছে পবিত্র একটা পাথর। রাজা পাথরের এ অংশটুকুতে অসংখ্য বড় ছোট পাথরের মাঝ দিয়ে যেতে হয় যেটা পুরো বোট জার্নির সবথেকে সুন্দর অংশ। কিছুক্ষনের মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে এলো এবং অন্ধকারেই আমাদের বোট সামনে এগোতে থাকল। থানচী থেকে পুরো ২.৫ ঘন্টা বোট জার্নি করার পর আমরা রেমাক্রীতে পৌছলাম। রেমাক্রীতে নেমেই আমরা আমাদের ট্যুর প্লানে কিছুটা চেঞ্জ আনি। সিদ্ধান্ত হল ফিরার দিন জিনাপাড়া হতে পদ্মঝিরি দিয়ে না ফিরে আমরা রেমাক্রী দিয়েই ফিরব। তাই মাঝিদের আমরা জানিয়ে দিলাম ১৬ ডিসেম্বর ১১.০০ টার সময় রেমাক্রীতে থাকার জন্য। গাইড আমাদের নিয়ে গেল নাফাখুম গেষ্ট হাইজে। আমরা একটা বড় রুম এবং দুটো ছোট রুম নিলাম। থাকা জনপ্রতি ১৫০ করে। রুমে কোন আসবাবপত্র নেই ফ্লোরে শুধু বিছানা বিছানো কিন্তু এরকম কটেজে কাটানো একটি রাত ফাইভস্টার হোটেলে কাটানো রাত্রের চেয়ে কোন অংশে কম মনে হবে না। কটেজে উঠেই প্রথমে রাত্রের খাবারের অর্ডার দিলাম। এবার মেন্যুতে ছিল ডিম, ডাল, সবজি, ভাতের প্যাকেজ জনপ্রতি ১০০ টাকা করে। নাফাখুম কটেজে সন্ধ্যা ৭ টা হতে রাত ১০ টা পর্যন্ত জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ দেওয়া হয়। সবাই সবার মোবাইল চার্জে দিয়ে দিলাম। ফ্রেস হয়ে রাত্রের অন্ধকারেই বের হয়ে গেলাম পাড়া দেখতে। ৫ মিনিট হাটার পর চলে গেলাম রেমাক্রী বাজারে। এখানে এক দোকনের দিদির সাথে কিছুক্ষন গল্প করে নিচে চলে আসলাম রেমাক্রী খালের পাশে। এখানে কিছুক্ষন আড্ডা দিয়ে কটেজে ফিরে আসলাম। রাত্রের খাবার খেয়ে ঘুমানোর আগে গাইডকে জানিয়ে দিলাম আগামীকাল নাফাখুমের উদ্দেশ্যে ট্রেকিং শুরু হবে সকাল ৮ টায়।
দিন ০২ঃ (১৪ অক্টোবর, ২০১৯)
সকাল ৬ টায় ঘুম থেকে উঠে সবাই খুব দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিলাম। আগের দিন রাত্রে অর্ডার করে রাখা খিচুড়ি, ডিম, আলুভর্ত্তা খাওয়ার টেবিলে পরিবেশন করা হল। সকালের নাস্তা সেরে গাইডের রেডি করে রাখা লাঠি নিয়ে আমরা নাফাখুম কটেজকে বিদায় জানাই। কটেজ থেকে নেমে ৫ মিনিট হাটলেই রেমাক্রী ফলসের দেখা মিলবে। যেহেতু আমরা ফেরার দিন এ পথ দিয়েই যাব তাই রেমাক্রী ফলসের পাশেই গাইডের পরিচিত এক দোকানে আমারা আমাদের অপ্রয়জনীয় কিছু জামা কাপড় রেখে নেই। এতে ব্যাগের ওজন কিছুটা কমে যায়। রেমাক্রী ফলসে ১০ মিনিট সময় ব্যায় করে আমরা আমাদের ট্যুরের প্রথম ট্রেকিং শুরু করি। রেমাক্রী খালের পাশ দিয়ে পাথুরে রাস্তা ধরে হাটা শুরু করি। এ পথে কোন পাহাড় ডিঙ্গাতে হবে না এবং রেমাক্রী খাল ও দুপাশের পাহাড়ের সৌন্দর্য্য পুরো পথেই আপনাকে সঙ্গ দিবে। প্রায় ১ ঘন্টা হাটার পর একটি দোকানের দেখা পাই যেখানে সবাই কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে আবার হাটা শুরু করি। রেমাক্রী থেকে নাফাখুম হয়ে জিনাপাড়া যাওয়ার রাস্তার প্রতিটা ভিউ একেকটি স্পটের মত মনে হবে। রেমাক্রী খালের সৌন্দর্য্য যত দেখছিলাম তত মুগ্ধ হচ্ছিলাম। আস্তে হাটলেও ২ থেকে ২.৩০ ঘন্টা মধ্যে নাফাখুম পৌছানো যায় কিন্তু আমরা সেদিন রেকর্ড করেছিলাম ৩.৩০ ঘন্টায় নাফাখুম পৌছে। নাফাখুমে পৌছে সবার প্রথমে গাইডকে বলে দিলাম নাফাখুম পাড়ায় দুপুরের খাবারের অর্ডার দিতে। নাফাখুম জলপ্রপাতের কাছে না গিয়ে প্রথমেই আমরা লাইফ জ্যাকেট পড়ে নেমে গেলাম নাফাখুমের পানিতে গোলস করতে। সাতার জেনে পানিতে গোসল করার চেয়ে সাতার না জেনে লাইফ জ্যাকেট পড়ে পানিতে ভেসে থাকার মজাটাই বেশি মনে হচ্ছিল। পানিতে অনেকক্ষন সময় কাটানোর পর সবাই নাফাখুম জলপ্রপাতের সামনে ও উপরের অংশে গিয়ে ছবি তুললাম। তারপর নাফাখুম পাড়ায় উঠে দুপুরের খাবার খেয়ে রওনা দিলাম জিনা পাড়ার উদ্দেশ্যে। একই খালের পাশ দিয়ে আবার হাটতে শুরু করলাম। যতই গহীনে যাচ্ছিলাম ততই সুন্দর মনে হচ্ছিল প্রকৃতি। রেমাক্রী থেকে নাফাখুম ও নাফাখুম থেকে জিনাপাড়া এই পুরো জার্নিতে আমাদের ৪/৫ বার হাটু সমান পানিতে রেমাক্রী খাল পার হতে হয় যদিও বর্ষার সময় পানির পরিমান থাকে বুক সমান। প্রায় ৩ ঘন্টা হাটার পর আমরা জিনা পাড়ায় পৌছলাম। জিনাপাড়ায় পৌছে গাইডের ঠিক করে রাখা ঘরে উঠলাম। এবার এক রুমেই ১৪ জনকে থাকতে হল। সবাই গোসল সেরে রাত্রের খাবারের জন্য মুরগী, ভাত, ডাল, সবজীর অর্ডার দিয়ে দিলাম। রাত্রের খাবার খেয়ে রুমের ভিতরেই চলল আড্ডা। দীর্য় সময় হাসি মজার পর যখন ঘুমানোর চেষ্টা করলাম তখন চোখে ঘুম ছিল না। কিন্তু পরের দিন দেবতা পাহাড় নামার কথা মনে করতেই ঘুম চলে আসল। গাইডকে বলে রাখলাম পরের দিন ট্রেকিং শুরু হবে সকাল ৭ টায়।
দিন ০৩ঃ (১৫ অক্টোবর, ২০১৯)
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে আগের দিন রাত্রেই অর্ডার করে রাখা খিচুড়ি, ডিম, আলুভর্ত্তা খেয়ে বের হয়ে পড়লাম। ট্রেকিং শুরু হল সকাল ৭টায়। এবার আমাদের সাথে ছিল লোকাল গাইড টনি দা। আজকের গন্তব্য দেবতা পাহাড় হয়ে আমিয়াখুম, সাতভাইখুম ও ভেলাখুম। জিনাপাড়া থেকে আমিয়াখুম যাওয়ার রাস্তা দুটো। একটা ঝিরি পথ + পাহাড়ি পথ আরেকটা শুধু পাহাড়ি পথ। শুধু পাহাড়ি পথ দিয়ে গেলে নিকোলাস নামক একটা পাহাড়ের চূড়ায় গ্রামীন ও রবির মোবাইল নেট পাওয়া যায়। তাই আমরা গাইডকে বললাম যাওয়ার সময় পাহাড়ি পথ ও আসার সময় ঝিরিপথ দিয়ে আসার জন্য। ট্যুরের তৃতীয় দিন মানে আজকে প্রথম আমাদের পাহাড়ে ট্রেকিং করার সৌভাগ্য হল। প্রায় আধাঘন্টা হাটার পর প্রথম পাহাড়ের চূড়ায় আমরা বিশ্রাম নিলাম। সেখানে আমরা এক বড় ভাই ও আপুকে পেলাম যারা প্রথম পাহাড় উঠেই আর না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল । অনেক রিকোয়েষ্ট করলাম আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য কিন্তু তারা সাফ জানিয়ে দিল তাদের দ্বারা আর সম্ভব না। কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে ঢাকা থেকে আনা খেজুর, কিসমিস খেয়ে আবার ট্রেকিং শুরু করলাম। এবার আধাঘন্টা হাটার পর একটা পাহাড়ের চূড়ায় গেলাম যেটার নাম নিকোলাস। পাহাড়ের চূড়ায় দু/তিনটা পরিবারের বসবাস। পাড়ার নাম নিকোলাস পাড়া। সবাই মোবাইল নেট পেয়ে যার যার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করলাম। এখানে ১৫ মিনিট সময় ব্যায় করে আমরা আবার হাটতে শুরু করলাম। কিছুক্ষন হাটার পর পৌছে গেলাম দেবতা পাহাড়ের চূড়ায়। এবার দেবতা পাহাড় নামার পালা। রাস্তা একটাই তাই গাইডকে সবার পিছনে রেখে নামা শুরু করলাম। দেবতা পাহাড়ের কিছু কিছু জায়গা ৮০/৯০ ডিগ্রি খাড়া তাই সবাই সর্বোচ্চ সাবধানতার সাথে নামছিলাম। প্রায় ১ ঘন্টার কিছু বেশি সময় লাগল এ পাহাড় নামতে। নীচে নেমে ডানের রাস্তাটা চলে গেছে ভেলাখুম ও নাইক্ষংমুখে এবং বামের রাস্তাটা আমিয়াখুম ও সাতভাইখুমের দিকে। আমরা প্রথম ভেলাখুমে গেলাম। কয়েক সাইজের ভেলা দেখলাম। একটাতে ৫ জন ও আরেকটাতে ১০ জন বসে সবাই ভেলাখুমের শেষে নাইক্ষংমুখ নামলাম। নাইক্ষংমুখে অনেক বড় ছোট পাথর ও ঝিরি পথের মত পানি দেখতে পেলাম। নাইক্ষংমুখে প্রায় ৫-১০ মিনিট হাটলে কিছু ছোট ঝর্নার দেখা পাওয়া যেত কিন্তু সেদিকে না গিয়ে ফিরতি ভেলার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। অনেক সময় লেগে গেল ফেরার ভেলা পেতে। ভেলাখুম থেকে ফিরে চলে গেলাম আমিয়াখুমের দিকে। আমিয়াখুম জলপ্রপাত নাফাখুমের থেকে অনেকটা বড় এবং ঝর্নায় পানির পরিমানও অনেক বেশি। যারা আমিয়াখুম আসবেন তারা অবশ্যই আগে আমিয়াখুমে সময় কাটাবেন পড়ে ভেলাখুমে যাবেন। সময় সল্পতার কারনে বেশিক্ষন থাকতে পারলাম না আমিয়াখুমে। তিনটার মধ্যে আবার দেবতা পাহাড় উঠা শুরু করলাম। দেবতা পাহাড় নামার থেকে উঠা অনেক সহজ মনে হল। প্রায় ৪৫ মিনিটের মধ্যে আমরা দেবতা পাহাড়ের চূড়ায় পৌছে গেলাম। তারপর পাহাড় + ঝিরি রাস্তা দিয়ে ট্রেকিং করে জিনাপাড়া পৌছাতে আমাদের সময় লাগল প্রায় ১.৩০ ঘন্টার মত। জিনাপাড়া পৌছানোর আগেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। পাড়াতে ঢুকে সবাই গোসল সেরে রাত্রের খাবার খেয়ে নিলাম। পরের দিন সকাল ৬.০০ টায় ফেরার জার্নি শুরু হবে তাই সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম।
দিন ০৪ঃ (১৬ অক্টোবর, ২০১৯)
সকাল ০৪ টায় সবাই ঘুম থেকে উঠলাম। ফ্রেস হয়ে নাস্তা করে বের হতে হতে ৬.০০ বেজে গেল। জিনাপাড়া কে বিদায় জানিযে কিছুক্ষন হাটার পর সেই রেমাক্রী খাল আবার আমাদের সঙ্গী হল। খালের পাড় ধরে প্রায় ২.৪৫ ঘন্টা হাটার পর পৌছে গেলাম নাফাখুমের সামনে সেখানে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম রেমাক্রী উদ্দেশ্যে। পথে এক দোকানে ডিম ও পিঠা খেয়ে নিলাম। প্রায় ২.৩০ ঘন্টা হাটার পর যখন রেমাক্রী পৌছালাম তখন সবার মুখেই বিজয়ের হাসি কারন যে পথ যাওয়ার দিন আমরা ৭+ ঘন্টায় পাড়ি দিয়েছিলাম তা আজ ফিরার দিন মাত্র ৫.৩০ ঘন্টা পাড়ি দিয়েছি। রেমাক্রী পৌছে দেখি আমাদের বোট আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। রেমাক্রী খালের পাশে ১০ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে বোটে উঠে পড়ি। এবার স্রোতের অনূকুলে চলতে লাগল আমাদের নৌকা। রেমাক্রী আসার দিন সন্ধ্যা হয়ে যাওয়াও যে দৃশ্য গুলো মিস করেছিলাম তা আজ দেখতে লাগলাম। প্রায় দুঘন্টার মধ্যে পৌছে গেলাম থানচী বাজারে। বোট থেকে নেমে বোট ভাড়া দিয়ে এবং লাইফ জ্যাকেট ফেরৎ দিয়ে চান্দের গাড়ী ভাড়া করতে বের হলাম। চান্দের গাড়ী ভাড়া ভাড়া করতে গিয়ে আরেক প্রবলেমে পড়লাম। ওইদিন যে কয়টা গাড়ী থানচী বাজারে ছিল কেউই ৭০০০ টাকার কমে রাজী হচ্ছিল না। প্রচুর ট্যুরিস্ট রেমাক্রী থেকে ব্যাক করছিল তাই কিছুক্ষন পর চান্দের গাড়ী না ও পাওয়া যেতে পারে। অনেক রিকোয়েষ্ট করার পর একজন ড্রাইভারকে ৬০০০ টাকায় রাজি করাই। দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা চান্দের গাড়ীতে উঠে পড়ি। বান্দরবান পৌছাতে প্রায় ৩ ঘন্টার মত লেগে গেল। বাস ছাড়তে এখনও ৩ ঘন্টার মত বাকি তাই ফ্রেস হয়ে সবাই ১০ টাকা অটো ভাড়া দিয়ে চলে গেলাম বার্মিজ মার্কেটে। সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে রাত্রের খাবার খেয়ে বাসে উঠে পড়লাম। ভোর ৪.৩০ এ আমাদের বাস ঢাকায় নামিয়ে দিল এবং এর মধ্যে দিয়ে শেষ হল আমাদের চারদিনের বান্দরবান ট্যুর।