খুলনা জেলার রূপসা উপজেলার ৫ নং ঘাটভোগ ইউনিয়নের অধীন পিঠাভোগ গ্রাম বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতৃকুলের ইতিহাসের সাথে অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িত। রবীন্দ্রনাথের জীবন ও বংশগত ধারা আলোচনা করতে গেলেই এই পিঠাভোগ গ্রাম এসে দাঁড়ায় অপরিহার্যভাবে। পিঠাভোগ গ্রামের কুশারী বংশের বিচ্ছিন্ন একটি লতিকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তথা ঠাকুর বংশের পূর্বপুরুষ।
Entrance of Kushari Bari. Photo: Sadman Rafid
কুশারি থেকে ঠাকুর বংশের নামকরণের ইতিহাস
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষের পদবি ছিল কুশারি। এটিও তাদের আসল পদবি নয়। এক সময় তারা বর্ধমান জেলার কুশ গ্রামের পত্তন পেয়েছিলেন। এ কারণে তারা কুশারি গোত্রভুক্ত হন। এই কুশারিরা পাবর্তীতে খুলনা, ঢাকা ও বাকুড়ায় বসতি গড়েন। তাদের একটি শাখা খুলনার পিঠাভোগ গ্রামে পত্তন নেন। কুশারিরা এখনও এই গ্রামে বাস করেন।
পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে উপমহাদেশের প্রখ্যাত আউলিয়া হযরত খানজাহান আলি খুলনা অঞ্চলে আসেন। এর দু’শ বছর আগে থেকেই কুশারিরা পিঠাভোগ গ্রামে বাস করে আসছেন। শ্রুতি আছে কুশ গ্রামের তারানাথ কুশারি পিঠাভোগ গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন। তিনিই পিঠাভোগ গ্রামের কুশারিদের আদি পিতা। তারানাথ কুশারির ছিল দুই পুত্র রামগোপাল ও রামনাথ। রামগোপালের পুত্র জগন্নাথ কুশারি দক্ষিণ ডিহির শুকদেব রায় চৌধুরীর কন্যাকে বিয়ে করেন। শুকদেব রায় চৌধুরীরা বনেদি ব্রাহ্মণ ও জমিদার হওয়া সত্ত্বেও ঘটনাচক্রে পিরালী ব্রাহ্মণে পরিণত হন।
দক্ষিণডিহি গ্রামের জমিদার দক্ষিণানাথ রায় চৌধুরীর চার ছেলের মধ্যে শুকদেব ছিলেন চতুর্থ। শুকদেবের অপর তিন ভাই হচ্ছেন- কামদেব, জয়দেব ও রতিদেব। এসময় হযরত খানজাহান আলি তাঁর প্রধান সহচর পীর আলী তাহিরকে এই অঞ্চলের শাসক নিয়োগ করেন। দক্ষিণানাথের পুত্র কামদেব ও জয়দেব পীর তাহেরের দেওয়ান নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে তারা ঘটনাচক্রে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এ কারণে তাদের অপর দুই ভাই রতিদেব ও শুকদেব সমাজচ্যুত ও পতিত ব্রাম্মণে পরিণত হন। এই অবস্থায় রতিদেব সন্নাস গ্রহণ করে দেশ ছাড়েন। অপরদিকে অবিবাহিত এক বোন ও এক কন্যা নিয়ে বিপাকে পড়েন শুকদেব। তিনি অনেক টাকার বিনিময়ে পিঠাভোগ গ্রামের জগন্নাথ কুশারির সংগে কন্যার বিয়ে দেন। পীরালী ব্রাহ্মণ-কন্যাকে বিয়ে করায় সমাজচ্যুত হন জগন্নাথ কুশারি এবং বাধ্য হয়ে তিনি পিঠাভোগ গ্রাম ছেড়ে বর্তমান খুলনার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহি গ্রামে চলে আসেন। এখানে শ্বশুরের দেওয়া জায়গায় তিনি বসতবাটি নির্মাণ করেন। এভাবেই রবি ঠাকুরের দক্ষিণডিহির মাতৃকূল ও শ্বশুরকুলের রায় চৌধুরী বংশের সাথে কবির আদিপুরুষ পিঠাভোগের কুশারী বংশের প্রাচীনকালে আত্মীয়তার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সম্পর্কটি ষোড়শ শতাব্দীর কোন এক সময়ের। এই জগন্নাথ কুশারীর দ্বিতীয় পুত্র পুরুষোত্তম থেকেই ঠাকুর ধারা প্রবাহমান।
জগন্নাথ কুশারীর পরবর্তী বংশধর পঞ্চানন কুশারী পারিবারিক মত পার্থক্যের কারণে দক্ষিণডিহি ত্যাগ করেন। পঞ্চানন কুশারী ও শুকদেব কুশারী কলকাতায় এসে গোবিন্দপুর গ্রামে হিন্দু সমাজের হরিজন পল্লীতে (নিম্নবর্গীয় ব্রাত্য পল্লী) বসবাস করতে থাকেন। খুলনার পতিত বা পিরালী ব্রাহ্মণদের পেয়ে গোবিন্দপুরের হরিজন পল্লীতে সকলেই খুশি। কারণ ওই গ্রামে আগে কোনো ব্রাহ্মণ ছিল না। হিন্দুদের কাছে ব্রাহ্মণরা ঠাকুর বা দেবতুল্য। গ্রামে ব্রাহ্মণ এসেছে বা ঠাকুর এসেছে। ঠাকুররা সম্মানীয়। তাদের তো বংশ পদবী ধরে ডাকা যায় না। সে কারণে তাদেরকে ‘ঠাকুর’ মহাশয় বলেই ডাকা শুরু হয়। সেই থেকে পঞ্চানন কুশারী হয়ে গেলেন পঞ্চানন ঠাকুর মহাশয়। তাদের নামের সঙ্গে কুশারী পদবি ঢাকা পড়ে যুক্ত হয় ঠাকুর পদবি।
কলকাতার গোবিন্দপুর গ্রামের পঞ্চানন ঠাকুরের পরবর্তী বংশধর নীলমনি ঠাকুর অর্থ সম্পদের মালিক হয়ে জোড়া সাঁকোয় যেয়ে বসবাস শুরু করেন। জোড়া সাঁকোয় ঠাকুর বংশেই ১৮৬১ সালে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র নোবেল বিজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
পিঠাভোগ গ্রামে যাত্রা
খুলনায় বসবাস করলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষের বসতভিটা বা কুশারিদের সম্পর্কে আমার জানা ছিল না। এইচএসসি পরীক্ষার আগে কোচিংএ পরিচয় হয় হৃদয় কুশারির সাথে, যে কিনা কুশারি বংশের ১৮তম প্রজন্মের সদস্য (উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন কুশারি বংশের ১৩তম প্রজন্ম)। মূলত হৃদয়ের মাধ্যমেই খুলনার কুশারি বংশের সাথে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের যোগসূত্রের ব্যাপারে জানা।
এরপর বহু বছর পর সম্প্রতি ইউটিউবে এক ভারতীয় ইউটিউবারের বাংলাদেশ ভ্রমণের ভিডিওর কমেন্ট দেখতে দেখতে চোখে পড়লো একটা কমেন্ট, যেখানে তাকে পিঠাভোগ গ্রামে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। তখন আমার মনে হলো, যেহেতু জায়গাটা খুলনা শহরের ঠিক পাশের উপজেলায়, তাহলে আমি নিজেই গিয়ে ঘুরে আসি। হাতে অবসর সময় ছিলো, আর তাই ১৩ আগস্ট বেলা ১১টায় বেরিয়ে পড়লাম পিঠাভোগ এর উদ্দেশ্যে।
প্রথমে এলাম খুলনা শহরে পূর্ব প্রান্তের রূপসা ঘাটে, সেখান থেকে ট্রলারে নদী পার হয়ে ভ্যানে উঠে পড়লাম, গন্তব্য কাজদিয়া বাজার। রূপসা ঘাট থেকে ৬.৬ কিলোমিটার পিচঢালা মসৃণ পথ ভ্যানে চড়ে কাজদিয়া বাজারে পৌছলাম। এই কাজদিয়ার চারপাশে রূপসা উপজেলার প্রশাসনিক কার্যালয়গুলো অবস্থিত। কিছুক্ষণ কাজদিয়ার আশেপাশে ঘুরে বেড়ালাম। শনিবার বিধায় সরকারি অফিসপাড়া ছিলো ফাঁকা, তবে বাজারে লোকজন ছিলো।
কাজদিয়া থেকে আবার ভ্যানে চড়ে বসলাম, সময় তখন বেলা ১২টা ২০, এবার গন্তব্য আলাইপুর বাজার। ১.৮ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ভৈরব নদী পার হয়ে পৌছলাম আলাইপুর বাজারে। এই বাজারটি আঠারোবাঁকি নদী ও ভৈরব নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত। বাজারের ঠিক পাশেই ৫ নং ঘাটভোগ ইউনিয়ন পরিষদ অবস্থিত। বাজারে পৌঁছে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম আঠারোবাঁকি নদীর পাড়ে ও নদীর উপরে আলাইপুর সেতুতে। আলাইপুর বাজার থেকে কাছেই কুশারিবাড়ি। আলাইপুর বাজার থেকে ৮০০ মিটার ইটের খোয়া বিছানো রাস্তা হেঁটে দুপুর ১টা ২৫ এ পৌছলাম কুশারিবাড়ির সম্মুখ দরজার সামনে। দৃষ্টিনন্দন এই গেটটি নির্মাণ করা হয়েছে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির গেটের আদলে।
Commemorative plaque. Photo: Sadman Rafid
গেট এর নিচ দিয়ে ভিতরের দিকে চলে গেছে একটি কংক্রিটের পাকা রাস্তা। রাস্তার মাথায় গিয়ে একটু আশাহত হলাম। রাস্তায় মাথায় আছে একটা ফাঁকা জায়গা, যেখানে জামাকাপড় শুকাতে দেয়া হয়েছে। ফাঁকা জায়গার বাম তথা পশ্চিম পাশে আছে একটা দেয়াল বা ফলক, যেখানে কুশারি বংশের ও পিরালি জাতের উৎপত্তির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, কুশারি থেকে ঠাকুর নামের উৎপত্তির ইতিহাস ও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের একটি তালিকা লেখা আছে। ফলকটির পাশে আছে একটি সংগ্রহশালা, যার নাম “পিঠাভোগ রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালা”। সংগ্রহশালার গেট তালাবদ্ধ থাকায় ভিতরে ঢুকতে পারিনি। বাইরে থেকে যেটুকু দেখা যায় তাতে জানতে পারলাম যে সংগ্রহশালাটির স্থানে পূর্বে একটি পুরাতন ভবন ছিল। এছাড়া ফাঁকা জায়গার উত্তর পাশে একটা কংক্রিটের ছাউনি দেয়া মঞ্চ, মঞ্চের উপরে রবীন্দ্রনাথের একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা আছে।
দেখার মতো ও করার মতো কিছু নেই বলে মিনিট দশেক অবস্থান করার পর ফেরার পথ ধরলাম। পিঠাভোগ থেকে আলাইপুর, আলাইপুর থেকে কাজদিয়া ও রূপসা ঘাট হয়ে খুলনা শহরে ফিরলাম।
যেভাবে যাবেন
খুলনা শহর থেকে রূপসা ঘাটে এসে রূপসা নদী পেরিয়ে ভ্যানে অথবা মহেন্দ্রতে চড়ে প্রথমে কাজদিয়া বাজার আসতে হবে। এখান থেকে ভ্যানে আলাইপুর বাজার, আলাইপুর বাজারের আগে পিঠাভোগ টেম্পু স্ট্যান্ডে নেমে ৬০০ মিটার পূর্ব দিক হাঁটলে কুশারি বাড়ির সদর দরজায় পৌঁছে যাবেন।
বাগেরহাট বা গোপালগঞ্জ এর দিক থেকে আসলে ফকিরহাট থেকে কাজদিয়া বাজার এসে একইভাবে পিঠাভোগ আসা যায়।
রবীন্দ্রনাথ কি কখনো পিঠাভোগে এসেছিলেন?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮২ সালে নিজের বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে, ১৯০০ সালে বন্ধুর নিমন্ত্রণে ও ১৯০৮ সালে একটি মামলায় সাক্ষ্য দিতে খুলনায় এসেছিলেন। তবে কোনোবারই তিনি তার পিতৃপুরুষ কুশারী বংশের ভিটা পিঠাভোগে আসেননি।
Click here to see my connect post about the flower nurseries of Swarupkathi
ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার জন্য।


