বাংলা পঞ্জিকা কেবল নিছক ক্যালেন্ডার মাত্র নয়। বাংলা দিনপঞ্জির সাথে কৃষি, জ্যোতিষ, তিথি, সমাজ, গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান, ঋতুপরিবর্তন ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
বাংলা বর্ষপঞ্জির যেকোনো মাসের শেষদিন সংক্রান্তি নামে পরিচিত।
সংক্রান্তি অর্থ সঞ্চার বা গমন করা। সূর্যাদির এক রাশি হতে অন্য রাশিতে সঞ্চার বা গমন করাকে সংক্রান্তি বলা হয়। সংক্রান্তি শব্দটি বিশ্লেষণ করলেও একই অর্থ পাওয়া যায়;
সং+ক্রান্তি, সং অর্থ সাজা এবং ক্রান্তি অর্থ সংক্রমণ। অর্থাৎ ভিন্ন রূপে সেজে অন্যত্র সংক্রমিত হওয়া বা নূতন সাজে, নূতন রূপে অন্যত্র সঞ্চার হওয়া বা গমন করাকে বোঝায়। বাস্তবেও তা-ই দেখা যায়। মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ এবং মীন এই বারটি রাশি একটির পর আরেকটি চক্রাকারে অবর্তিত হতে থাকে। রাশিচক্রস্থ দৃশ্যমান গমন পথ, সেপথে সূর্য গমনের ফলে (জ্যোতিষতত্ত্বমতে) পৃথিবীর পরিমণ্ডলে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে ও ঋতুপরিবর্তন হয়। এভাবে পৃথিবী নানারূপে সঞ্চারের কারণে প্রাকৃতিক দৃশ্যপট প্রতিমাসে পরিবর্তিত হতে থাকে। জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী পৃথিবীর পরিমণ্ডলে এধরণের পরিবর্তনের মধ্যে চারটি দিন উল্লেখযোগ্য। তারমধ্যে দুই অয়ন এবং দুই বিষুব দিন। দুই অয়ন হল উত্তরায়ন ও দক্ষিণায়ন এবং বিষুব হল মহাবিষুব ও জলবিষুব। চৈত্র সংক্রান্তিতে মহাবিষুব ও আশ্বিন সংক্রান্তিতে জলবিষুব আরম্ভ হয়। উল্লেখ্য বছরে যে দুইদিন দিবা ও রাত্রি সমান হয় তাকে বিষুব দিন বলা হয়। বসন্তকালে যে বিষুব হয়, তাকে মহাবিষুব আর শরৎকালে যে বিষুব হয় তাকে জলবিষুব বলা হয়। সূর্য ধনুরাশি ত্যাগ করে মকর রাশিতে সঞ্চার হওয়াকে উত্তরায়ণসংক্রান্তি, মিথুনরাশি হতে কর্কটরাশিতে সঞ্চার হওয়াকে দক্ষিণায়ন সংক্রান্তি, কন্যারাশি হতে তুলারাশিতে সঞ্চার হওয়াকে জলবিষুবসংক্রান্তি আর মীনরাশি হতে মেষরাশিতে সঞ্চার হওয়াকে মহাবিষুব সংক্রান্তি বলা হয়ে থাকে। দুই অয়নে এক বছর হয়। পনের দিন-রাতে এক পক্ষ, দুই পক্ষে এক মাস, ছয় মাসে এক অয়ন আর দুই অয়নে এক বছর হয়। মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ আষাঢ় এই ছয় মাস উত্তরায়ন কাল এবং শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ ও পৌষ এই ছয় মাস দক্ষিণায়ন কাল। সেজন্য আষাঢ়ের সংক্রান্তিতে দক্ষিণায়ণ এবং পৌষ সংক্রান্তিতে উত্তরায়ণ শুরু হয়। অয়ন ভেদে সূর্যেরও দিক পরিবর্তন হয়। উত্তরায়ণে সূর্যের সঞ্চার হওয়া মাত্র সূর্য দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে এবং দক্ষিণায়ণে পুনরায় সূর্য দক্ষিণ দিকে সঞ্চার হতে আরম্ভ করে।
পৌষ মাসের শেষ দিন পৌষসংক্রান্তি নামে পরিচিত। এদিন সূর্য উত্তরায়ণের দিকে যাত্রা শুরু করে বলে এই সংক্রান্তিকে উত্তরায়ণ সংক্রান্তি এবং সূর্য মকররাশিতে প্রবেশ করে তাই উত্তরায়ণ সংক্রান্তিকে মকরসংক্রান্তি ও বলা হয়।
পৌষ সংক্রান্তি বা উত্তরায়ণ সংক্রান্তি কে ঘিরে সনাতন ধর্মের অনুসারীগণ উৎসবে মেতে ওঠে। তাঁরা উক্ত দিনে তিল দিয়ে তৈরী করা নাড়ু, মিষ্টি, ফল ইত্যাদি দিয়ে পূজার নৈবেদ্য হিসাবে নিবেদন করে থাকেন। তাছাড়াও ঘরে ঘরে চলে নানারকমের পিঠাপুলির আয়োজন।
এই পৌষসংক্রান্তি ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ায় এই দিবস বা ক্ষণকে ঘিরে উদযাপিত হয় উৎসব। ভারতে মকরসংক্রান্তি, নেপালে এই দিবসটি মাঘি নামে, থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি মা লাও, মিয়ানমারে থিং ইয়ান এবং কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান নামে উদযাপিত হয়। অবশ্য দেশ ভেদে এর নামের মতোই উৎসবের ধরণে থাকে পার্থক্য।
আমাদের পুরান ঢাকায় এই পৌষ “সংক্রান্তি” ভাষার অপভ্রংশে সাকরাইন নামে অভিহিত।
সংক্রান্তি আর ঘুড়ি ওড়ানো যেন একসূত্রে গাঁথা। ভারতের গুজরাটে তো মহা সাড়ম্বরে পালন করা হয় মকরসংক্রান্তির দিন ঘুড়ি উৎসব!
আমাদের পুরান ঢাকা তেও এদিন বাড়ির ছাঁদে ছাঁদে চলে ঘুড়ি ওড়ানো। বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পালন করা হয় পৌষসংক্রান্তি বা সাকরাইন।
সকাল থেকেই বাড়ির ছাঁদে ছাঁদে ঘুড়ি নাটাই নিয়ে মেতে ওঠে ছোট বড় সকলেই। তারপর দিনভর চলে হরেকরকমের ঘুড়ির ওড়াউড়ি, ভোকাট্টা করায় আনন্দ! সন্ধ্যায় শুরু হয় আতশবাজি ও রঙবেরঙ ফানুশের খেলা।
তবে বর্তমানে আমাদের দেশে পহেলা বৈশাখের মতো এই পৌষসংক্রান্তি বা সাকরাইন নিয়েও তৈরি হয়েছে বিভাজন। বাংলা বর্ষপঞ্জি সৌর ও চান্দ্রমাসের অপূর্ব সমন্বয়। যা তিথি, অমাবস্যা, পূর্ণিমা, রাশি প্রভৃতি নির্ণয় নির্দেশ করে। কিন্তু সামরিক এরশাদ সরকার বিদ্বেষমূলক ভাবে ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ ধরে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের আদলে বাংলা পঞ্জিকা প্রণয়ন করে বাংলা বর্ষকে অথর্ব (useless) করে দেন। বছরের প্রথম পাঁচমাস ৩১ দিন ও পরের সাতমাস ৩০ দিন করে বাংলা ক্যালেন্ডার সাজানো হয় নামেমাত্র। স্বকীয়তা হারিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জি পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে যায় গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারের উপর। অমাবস্যা, পূর্ণিমা, সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ, তিথি বিষয়গুলো আর নির্ণয় হয়না উক্ত বাংলা ক্যালেন্ডারে। যার ফলে ১৪ এপ্রিল ও ১৫ এপ্রিল দুইদিন পালিত হয় পহেলা বৈশাখ।
- স্বকীয় বাংলা ক্যালেন্ডার
যাইহোক, এতদিন পহেলা বৈশাখে সীমাবদ্ধ ছিল। পৌষসংক্রান্তি/সাকরাইন পালিত হত পঞ্জিকা অনুযায়ী কখনো ১৪ জানুয়ারী বা কখনো ১৫ জানুয়ারী। কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েকবছর ধরে পৌষসংক্রান্তিও এরশাদীয় ক্যালেন্ডার অনুযায়ী কয়েক জায়গায় পালিত হচ্ছে ১৪ জানুয়ারী ধরে যা কখনো মাঘের ১ তারিখ পড়ে আবার কখনো ২৯ তারিখ। তবে এখনো সিংহভাগ মানুষ করে পঞ্জিকা অনুসারেই। যেটা এবছর পড়েছে ১৫ জানুয়ারী।
সবাইকে পৌষসংক্রান্তি তথা সাকরাইন এর শুভেচ্ছা।