প্রাচীন ইতিহাস এবং ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ সুনামগঞ্জ জেলা। বৃহত্তর সিলেট বিভাগের অন্তর্গত এই সুনামগঞ্জ জেলাটি নানারুপ প্রাকৃতিক বৈচিত্রে চিত্রায়িত। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে ভ্রমনপিয়াসু মানুষদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় জায়গা সুনামগঞ্জ জেলা। এই জেলার উত্তরে রয়েছে ভারতের খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়। আর তারই পাদদেশে রয়েছে হাওর বাওর বেষ্টিত এই ভাটির জনপদ। এক সময় এই জনপদটি আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। সুনামগঞ্জ জেলার দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো; টাঙ্গুয়ার হাওর, লালঘাট ঝর্না, টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি, নীলাদ্রী লেক খ্যাত শহীদ সিরাজ লেক, শিমুল বাগান, বারিক টিলা, যাদুকাটা নদী, লাউড়ের গড়, হাসান রাজার বাড়ি, পাগলা জামে মসজিদ, নারায়নতলা, ডলুরা শহীদ মিনার ইত্যাদি।
টাঙ্গুয়ার হাওরঃ
বাংলাদেশের সবছেয়ে বৃহৎ জলাশয়। মাছ ,বন, পাখী, জীববৈচিত্র, নির্মল বায়ূ, উন্মুক্ত আকাশ, মেঘালয় এর পাহাড় শ্রেণীর অপরূপ সৌন্দর্য্য এগুলিই টাংগুয়ার হাওরের বিশেষ বৈশিষ্ট। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বড় জলাভূমি। বর্ষাকালে হাওরটির আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ২০ হাজার একর। আর তার যে সৌন্দর্য, চোখে না দেখলে ঠিক বুঝা যাবে না। ভারতের মেঘালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এই টাঙ্গুয়ার হাওর। মেঘালয় পর্বত থেকে প্রায় ৩০টি ঝর্ণা এসে সরাসরি মিশেছে হাওরের পানিতে। সারিসারি হিজল-করচশোভিত, পাখিদের কলকাকলি সদা মুখরিত টাংগুয়ার হাওর। এটি মাছ, পাখি এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর এক বিশাল অভয়াশ্রম। টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রবেশ মুখেই দেখা যায় সারিসারি হিজলগাছ। দেখে মনে হবে এই গাছগুলো হাওরে আগত অতিথিদের অভিবাদন জানানোর জন্যই দাঁড়িয়ে আছে। মূল হাওরে প্রবেশ করলে হাওরের পানিতে নিচের দিকে তাকালে দেখা মিলবে জলজ উদ্ভিদের। দেখে মনে হবে পানির নিচে আরেক সবুজের স্বর্গরাজ্য।
শহীদ সিরাজ লেকঃ
টাঙ্গুয়ার হাওরের পাশেই একদম পাহারের কুল ঘেষে রয়েছে এই লেকটি। লেকের আশেপাশে অনেক সুন্দর নয়নাভিরাম জায়গা রয়েছে। একসময় এটি টেকেরঘাট চুনাপাথরের খনি ছিলো। এলাকার লোকজন এটাকে কোয়ারী নামেই চিনে। এর পানির রঙ এতটা নীল আর প্রকৃতির এক মায়াবী রুপ। মাঝের টিলা গুলা আর ওপাড়ের পাহাড়ের নিচের অংশটুকু বাংলাদেশ এর শেষ সিমানা। বড় উচু পাহাড়টিতেই সীমানা কাটা তারের বেড়া দেওয়া আছে। এই লেকটি এক সময় চুনা পাথরের কারখানার কাচামাল চুনা পাথরের সাপ্লাই ভান্ডার ছিল যা এখন বিলীন।
বারিক টিলা ও যাদুকাটা নদীঃ
এলাকার লোকজন এটাকে বারিক্কা টিলা, বারেকের টিলা নামেও বলে থাকে। টিলার ওপর দাঁড়িয়ে দেখা যায় দূর পাহাড়ের মেঘের হাতছানি। সবুজে মোড়া উঁচু টিলার একপাশে পাহাড়, অন্যপাশে স্বচ্ছ জলের নদী। হাওর-নদী-পাহাড়ের এই অপরূপ সৌন্দর্যের এ লীলাভূমি একটি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান। পূর্বে যাদুকাটা নদী, সে নদীর চিক চিক জলরাশি আপনাকে আকর্শন করতে বাধ্য। উত্তরে ভারতের মেঘালয় থেকে বয়ে আসা হিমশীতল জলে গাঁ ভাসানোতে রয়েছে এক অন্যরকম মাদকতা।
শিমুল বাগানঃ
বারেকের টিলার অদূরেই যাদুকাটা নদীর কুল ঘেষে রয়েছে আরেক নান্দনিক পর্যটন এলাকা নাম শিমুল বাগান। সাবেক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হাজী জয়নাল আবেদিন শখের বসে বিশাল এলাকা জুড়ে তৈরী করেছেন এই শিমুল বাগান। বর্তমানে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক তা পরিদর্শন করতে যায়। টাঙ্গুয়ার হাওর, শহীদ সিরাজ লেক ও বারেকের টিলা যারা ঘুরতে আসে এই শিমুল বাগানটিও তাদের ভ্রমণ তালিকায় থাকে। মার্চ এপ্রিলের দিকে শিমুল বাগান ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। কারন এ সময় বাগান ফুলে ফুলে সুরভিত এবং সুভাসিত হয়। লালে লাল হয়ে আগুন রাঙ্গা এক বাগান হয়ে উঠে এই শিমুল বাগান।
হাসান রাজার বাড়িঃ
সুনামগঞ্জের মরমী বাউল সাধক কবি হাসন রাজার নাম শুনে নাই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভাটি বাংলার যত বাউল শিল্পী রয়েছেন, শাহ আব্দুল করিম, রাধা রমন, দুরবিন শাহ প্রমুখদের মধ্যে হাসন রাজাও ছিলেন একজন উল্ল্যেখযোগ্য বাউল শিল্পী। হাসন্রাজা ছিলেন মুলত একজন প্রভাবশালী জমিদার। জমিদার হয়েও তার মধ্যে রয়েছিল অন্যরকম প্রতিভা। মাটিরও পিঞ্জিরার মাঝে বন্ধি হইয়ারে, লোকে বলে বলেরে ঘর বাড়ি ভালানা আমার, বাউলা কে বানাইলো রে, হাসন রাজারে বাউলা কে বানাইলো রে, এরকম অসংখ্য জনপ্রিয় বাউলগানের রচয়িতা তিনি। এই মরমী সাধক এর বাড়িটি রয়েছে শহরের নিকটবর্তী সুরমা নদীর তীরে লক্ষণছিরি এলাকায়। তার বাড়িটি এখন হাসন রাজা মিউজিয়াম করে রাখা হয়েছে।
নারায়নতলা ও ডলুরা শহীদ মিনারঃ
সুনামগঞ্জ শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার উত্তরে ভারত সীমান্তের কুল ঘেষে নারায়নতলা গ্রাম ও ডলুরা শহীদ মিনার অবস্থিত। শহর থেকে উত্তর পুর্ব দিকে এগিয়ে হালুয়াঘাট থেকে সুরমা নদী পার হয়ে, সিএনজি অথবা বাইক দিয়ে নারায়নতলা যাওয়া যায়। নারায়নতলায় রয়েছে একটি শহীদ মিনার, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া অনেক বীর সৈনিকের কবরস্থান। রয়েছে একটা নিরিবিলি পিকনিক স্পট।
তাছাড়া সুনামগঞ্জে রয়েছে আরো অনেক কিছু দেখার মত, তার মধ্যে লাকমা ছড়া, ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরী, ছাতক লালটিলা, আরকুম শাহের মাজার, ইংলিশ টিলা, বাশতলা শহীদ মিনার, চরকুম বাগ। রয়েছে পাগলা জামে মসজীদ, গৌরারং জমিদার বাড়ি, সুখাইর জমিদার বাড়ি ইত্যাদি।
এবার আসি সুনামগঞ্জ বেড়াতে আসলে কিকি খাবার খাবেন। প্রথমেই বলে রাখি সুনামগঞ্জে তেমন উল্লেয়খযোগ্য বিখ্যাত খাবার নেই বললেই চলে। তারপরেও, ভাটি বাংলার প্রধান খাবার হচ্ছে হাওরের তাজা মাছ। হাওরে পাওয়া যায় রুই, কাতলা, বোয়াল, মলা, ডেলা, ক্যাচকি, চিংড়ি ইত্যাদি ফরমালিন মুক্তা তাজা মাছ। তাই এই মাছের আইটেম ভ্রমণ এলাকায় রান্না করে খেতে মিস করা যাবেনা। আর রয়েছে হাসের মাংসের ভুনা। রাজ হাস, পাতিহাস এগুলো ভুনা রেসিপি একবার খেলে জীবনেও ভুলা যাবে না। আর রয়েছে বিভিন্ন রকমের পিঠাপুলি। যা সিজনে সিজনে পাওয়া যায়। যেমন শীতকালে, গ্রামে ভাপা পিঠা, নারকেল পিঠা ইত্যাদি।
সুনামগঞ্জে স্বাগতম আপনাকে, আসুন ঘুরে দেখি নিজের দেশ। #meetup200 #bdlg200 #bdlg #bangladeshlocalguides #localguidesbd