কর্মসূত্রে ঢাকায় অবস্থান করলেও ছুটি পেলেই ছুটে চলি মাটির টানে। মনটা যেন সেখানেই পরে থাকে। তেমনি এক ছুটিতে সহকর্মীরা মিলে পরিকল্পনা করছিলাম একদিনে কাছাকাছি কোথাও ঘুরে আসা যায় কিনা। সেই তালিকায় সিলেটও আছে দেখে যারপর নাই খুশিই হলাম। আর যখন দেখলাম সর্বাধিক ভোট “ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর” এ পরেছে তখন আমার খুশি আর কে দেখে।
যাই হোক, সিলেটি হিসেবে ট্রেনের টিকেট কেনার ভার আমার উপরই বর্তালো। কিন্তু ১২ জনের টিকেট ম্যানেজ করা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে ১২ জনের টিকেট ম্যানেজ করা হলো এয়ারপোর্ট থেকে। বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ৩০ এর ট্রেন। যথারীতি অফিস শেষে উবারে গাড়ি ভাড়া করে আমরা রওনা হলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যে। ৯ টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম স্টেশনে। যেহেতু অফিস শেষ হতে না হতেই রওনা হয়ে গিয়েছিলাম তাই সবার সম্মতিতে রাতের খাবারটা স্টেশনের পাশেই এক হোটেল থেকে সেরে নিলাম। ঠিক ১০ টা ১৫ তে স্টেশনে উপস্থিত হয়ে ড্যাশবোর্ড দেখতেই সবার মাথায় হাত। টিকেট দেখে স্টেশন মাস্টার থেকে নিশ্চিত হয়ে বুঝতে পারলাম যে ট্রেন আমাদের রেখে আরো ২৫ মিনিট আগেই চলে গেছে। আমরা কেউ খেয়াল করিনি যে টিকেট এয়ারপোর্ট থেকে কাটা হয়েছে, তাই সেখানকার ট্রেন ছাড়ার সময় উল্লেখ করা ছিল, আর আমরা ভেবেছি কমলাপুর থেকেই ঐ সময়ে ছাড়বে। অথচ আমরা নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই স্টেশনে এসে পৌঁছেছিলাম।
ভীষণ খারাপ লেগেছিল তখন যে আমার জন্যই সবার যাত্রা বাতিল করতে হয় কিনা। একজন তো বলেই বসল, “আমি বাসায় যাবো না। দরকার হলে এখানেই থাকবো তবু এই মুখ কাউকে দেখাতে পারবো না। সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে।” সবাই বেশ চিন্তিত কি করা যায় ভেবে। সবারই দৃঢ় প্রত্যয় ছিল যেভাবেই হোক আমাদের ভ্রমণ কিছুতেই বাদ দেয়া যাবে না। কেননা আমাদের একজন সহকর্মী এয়ারপোর্ট থেকে উঠবে বলেছিল তাই আমরা তাকে আমাদের অবস্থান জানিয়ে ট্রেনে উঠতে বললাম এবং আমরাও আসছি বলে উৎসাহিত করলাম।
এ বাসে ও বাসে করে প্রায় সবগুলো বাসেই চেষ্টা করা হলো কিন্তু কোথাও ১১ জনের সিট পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষে আমাদের আরেকজন সহযাত্রীর মাধ্যমে একটা মাইক্রো ভাড়া করে অবশেষে আমাদের ভ্রমণ শুরু করলাম। যথারীতি ভোর ছয়টা নাগাদ সিলেটে পৌঁছে আমাদের বাকি একজনকে সাথে নিয়ে স্টেশনের পাশের একটা হোটেল থেকে নাস্তা সেরে নিলাম। যেহেতু আমরা ১২ জন তাই একটা লেগুনা ঠিক করলাম সারাদিনের জন্য। উদ্দেশ্য ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর আর রাতারগুল। উল্লেখ্য আমি এর আগে এই দুটি জায়গায় যাইনি কখনো।
যাত্রাপথে গাড়ি থামিয়ে লাক্কাতুরা আর মালনীছড়ার সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে ভুলিনি। যেহেতু আমি চায়ের দেশের মেয়ে, আমার কাছে চা বাগান নতুন কিছু নয়। বাকি সবার আনন্দ উল্লাস দেখে আমারও বেশ ভাল লাগছিল। চারিদিকে এত সবুজের মাঝখানে আমাদের উপস্থিতি ফ্রেমবন্দী করতেও ভুল হলো না কারো। যেহেতু আমাদের হাতে বেশি সময় নেই সেহেতু এখানে কালক্ষেপণ না করে আমরা আবার আমাদের যাত্রা শুরু করলাম। এখানে যেহেতু যানজটের বালাই নেই তাই আমরা এত দূরের পথ নির্দিষ্ট সময়েই পাড়ি দিলাম।
ভোলাগঞ্জ পৌছেই চারিদিকে বিশাল বিশাল পাহাড় দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল, যদিও বেশির ভাগ পাহাড়ের মালিকানা ভারতের। বাতাসের ঘ্রাণে বেশ একটা তফাত লক্ষ্য করলাম। দূষিত বাতাসের ভীড়ে জর্জরিত আমরা বিশুদ্ধ বাতাসের পার্থক্যটা সহজেই বুঝতে পারলাম। যাই হোক, এবার আমাদের পাথরের দেশে যাবার পালা। সেজন্যে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া করলাম। এক নৌকায় ৮ জন করে উঠতে পারবে, তাই আমরা ৮ জন এক নৌকায় উঠে বাকি ৪ জন অন্য আরেকটা দলের সাথে নৌকা ভাগাভাগি করে নিলাম।
নৌকা থেকে নেমে আরো বেশ কিছুদূর হেঁটে যেতে হলো। একে তো মাথার উপর প্রচণ্ড রোদ তার উপর বালির রাস্তা, এটুকু পেরোতেই বেশ হাঁপিয়ে গেলাম সবাই। তার পর দেখা পেলাম সেই কাঙ্ক্ষিত নীল সাইনবোর্ডের যেখানে হলুদ এবং সাদা কালিতে “পর্যটন সম্পর্কিত নির্দেশাবলী” লেখা রয়েছে। তখনি বুঝতে পারলাম, অবশেষে আমরা আমাদের গন্তব্য “ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর” এ পৌঁছে গেছি।
যেদিকে চোখ যায় শুধু পাথর আর পাথর। পাথরের রাজ্যে চলে এসেছি যেন। সেই সাথে পাহাড় থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ পানির কলকল ধ্বনি আমাদেরকে সম্মোহিত করে ফেলছিল।
কারো আর তর সইছিলো না, কে কার আগে পানিতে নামবে এই নিয়ে চললো প্রতিযোগীতা। স্বচ্ছ শীতল পানিতে নেমেই সকল ক্লান্তি নিমেষেই কোথায় যেন হারিয়ে গেল। কেউ আর পানি ছেড়ে উঠে আসতে চাইছিলো না। ঘন্টা দুয়েক পানিতে দাপাদাপি করে অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও উঠে আসতে হলো। কেননা আমাদের ছিল ফেরার তাড়া।
কীভাবে যাবেনঃ
ঢাকা থেকে ট্রেন, বাস, উড়োজাহাজে অথবা ১০/১১ জন হলে একটা মাইক্রো ভাড়া করে যেতে পারেন। সিলেট পৌঁছে মানুষ বেশি হলে কদমতলী বাস টার্মিনাল অথবা বন্দর থেকে লেগুনা ভাড়া করে নিতে পারেন। সারাদিনের জন্য হলে ২৫০০-৩০০০ টাকা নিবে। এছাড়া অল্প মানুষ হলে আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে সি এন জি চালিত অটোরিকশায় করে চলে যেতে পারেন, ভাড়া পরবে একেকজনের ১৬০ থেকে ২০০ টাকা করে। এছাড়া রয়েছে বিআরটিসি ডাবল ডেকার বাস যেখানে ভাড়া পরবে প্রতিজনের জন্য মাত্র ৫০ টাকা। ওখানে নেমে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে বাকি পথ যেতে হবে। একটা নৌকায় ৮ জন উঠতে পারবেন, খরচ পড়বে ৮০০ টাকা।
জেনে রাখা ভালঃ
ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর পর্যটন এলাকায় পৌঁছে “পর্যটন সম্পর্কিত নির্দেশাবলী” পড়তে এবং মেনে চলতে অবশ্যই ভুল করবেন না যেন। এছাড়া যেহেতু প্রচন্ড স্রোত সেখানে তাই লাইফ জ্যাকেট সাথে নিয়ে পানিতে নামবেন। পানির নিচের পাথরগুলো অনেক পিচ্ছিল, তাই অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করবেন নইলে পরে গিয়ে মারাত্মকভাবে আহত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। মহিলাদের জন্য আলাদাভাবে ভেজা কাপড় পরিবর্তন করার ব্যবস্থা রয়েছে মাত্র ২০ টাকার বিনিময়ে।
#BDLGCPC #connectcontest #Bangladesh