খুলনা শহরে বাইরে থেকে আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব আসলে যে সমস্যায় পড়তে হয় তা হলো খুলনা শহরে উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো দর্শনীয় জায়গা নেই।
তবে শহরের বাইরে ঘুরতে চাইলে আছে বাগেরহাট, আর যশোরেও টুকটাক জায়গা আছে।
যাই হোক, খুলনার প্রধান আকর্ষণ হলো বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। যদিও সুন্দরবনের আসল মজা বনের গহীনে, কিন্তু এর জন্য আর্থিক সামর্থ্য আর সময় দুইটাই দরকার হয় (ট্যুরিস্ট ভেসেলে তিনদিনের ট্যুর)।
তবে এক দিন হাতে থাকলে চাইলেই খুলনা থেকে ঘুরে আসা যাবে সুন্দরবনের উপকণ্ঠে অবস্থিত করমজলে, যেখান থেকে আপনি সুন্দরবনের “মোটামুটি” স্বাদ পাবেন। সড়কপথে যেতে চাইলে খুলনা থেকে যেতে হবে মোংলা, সেখান থেকে বোটে চড়ে করমজল পৌঁছাতে হবে। তবে বর্তমানে মোংলার সড়কের অবস্থা খুবই খারাপ, তাই আজ আমি আপনাদের সাথে খুলনা থেকে সরাসরি নদীপথে করমজল যাওয়ার অভিজ্ঞতা শেয়ার করব।
গত ১৮ নভেম্বর আমরা খুলনা থেকে বোট ভাড়া করে করমজলে ভ্রমণ করি। এটা ছিল একটা ফ্যামিলি ট্যুর এবং দলের সদস্য ছিল মোট ১০ জন। বোটটা ছিল ফাইবার বোট এবং বোটটিতে ১০-১২ জন যাত্রী অনায়াসে ভ্রমণ করতে পারবেন। এছাড়া ইঞ্জিনের উপর কভার থাকায় ইঞ্জিনের শব্দও কম ছিল।
আমাদের যাত্রা শুরু হয় সকাল ৬টা ২০ এ, রূপসা ঘাট থেকে। আবহাওয়া ছিল হালকা ঠান্ডা, হালকা কুয়াশাও ছিল নদীতে। তখন নদীতে ছিল ভাটা, মূলত ভাটার টানে দ্রুত পথ অতিক্রমের জন্যই সকাল সকাল যাত্রা করতে হয়েছিল।
রূপসা ঘাট থেকে করমজল পর্যন্ত নদীপথের দুইপাশে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য স্থান ও স্থাপনা আছে, যেগুলোর গুরুত্ব করমজল দর্শন থেকে খুব একটা কম নয়। যেমনঃ
১. খুলনা শিপইয়ার্ড:
যাত্রা শুরুর পরে সর্বোপ্রথম চোখে পড়বে খুলনা শিপইয়ার্ড। দেশের মাটিতে সর্বোপ্রথম আধুনিক যুদ্ধজাহাজ নির্মাণের গৌরব আছে এই শিপইয়ার্ডের।
২. খানজাহান আলী সেতু:
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে উঁচুু সেতু এবং খুলনাবাসীর বিনোদনকেন্দ্র। সময় থাকলে আগে-পরে এখানেও এক বেলা ঘুরে আসতে পারেন।
৩. নির্মাণাধীন রূপসা রেল সেতু:
খুলনা ও মোংলাকে রেলপথে সংযুক্ত করতে রূপসা নদীর উপর নির্মাণাধীন দেশের দীর্ঘতম রেলসেতু এটি, যার দৈর্ঘ্য হবে ৫.১৩ কি.মি।
Sunrise at Rupsha River
৪. পানখালি ডলফিন অভয়ারণ্য:
রেল সেতু থেকে পানখালি এক ঘণ্টার পথ দূরে। অভয়ারণ্যের অবস্থান বটিয়াঘাটা উপজেলার শেষ প্রান্তে, রূপসা ও পানখালি নদীর মিলনস্থলে। নদীর উপর দৃষ্টি রাখলে ভাগ্য সহায় থাকলে এখানে দেখা পেয়ে যেতে পারেন বিপন্ন প্রজাতির গাঙ শুশুক (Ganges River Dolphins) ও ইরাবতী ডলফিন (Irrawaddy Dolphins) এর।
৫. নির্মাণাধীন রামপাল কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র:
বহুল আলোচিত-সমালোচিত, বিখ্যাত-কুখ্যাত “ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র” এর দেখা পাবেন পানখালি অতিক্রমের আধা ঘণ্টা পর।
৬. এলপিজি প্ল্যান্ট:
চালনা বাজার অতিক্রমের পরেই দেখা পাবেন বিশাল আকারের গোলকাকার এলপিজি রিজার্ভারগুলো। নদীর দুইপাড়ে বিশেষ করে পূর্ব পাড়ে দেশের স্বনামধন্য কোম্পানিগুলোর এলপিজি প্ল্যান্টগুলো দেখতে পাবেন। মূলত সমুদ্রপথে আসা এলপিজিবাহী ট্যাংকারগুলো এখানে এলপিজি আনলোড করে, এরপর সিলিন্ডারে ভরে এখান থেকেই সারা দেশে এলপিজি সরবরাহ করা হয়।
Cement Factory & LPG plants in Mongla
৭. মোংলা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি:
সেনা কল্যাণ সংস্থার মালিকানাধীন মোংলার গুরুত্বপূর্ণ শিল্প কারখানা।
৮. কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনাল সদর দপ্তর ও জেটি:
কোস্ট গার্ডের নৌবহরের এক ঝলক দেখতে পাবেন এখানে।
৯. বিএনএস মোংলা:
নৌবাহিনীর ঘাঁটি। নৌবাহিনীর একাধিক ফ্রিগেট এই ঘাঁটিতে সর্বদা মোতায়েন থাকে। তাই নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজগুলো কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাবেন।
১০. মোংলা সমুদ্রবন্দর:
দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর হলেও বন্দরের সক্ষমতার মাত্র ৩০ শতাংশই ব্যবহার হয়। বন্দরের জেটিতে তাই একটির বেশি জাহাজ থাকে না।
নদীর স্রোত অনুকূলে থাকায় যাত্রা শুরুর তিন ঘণ্টা পাঁচ মিনিট পর সকাল ৯টা ২৫ এ আমরা করমজল পৌছাই। পথে আমরা বোটেই সকালের নাস্তা করি। বাতাস না থাকায় নদী ছিল শান্ত। সূর্যের দেখা পাওয়া গেলেও সারা পথে কুয়াশা কাটেনি।
Entrance to the wildlife rescue center
করমজলে নেমে টিকিট কেটে ভিতরে প্রবেশ করি। ভিতরে প্রথমেই দেখা পাওয়া যায় কয়েকটি পাকা বাড়ির যেগুলো মূলত করমজলে অবস্থানরত বন বিভাগের কর্মচারীদের আবাস এবং বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সম্মেলন কক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এরপর দেখা হলো হরিণের দলের সাথে। পথের পাশের ছোট একটা ছেলের কাছ থেকে এক আঁটি পাতা কিনে হরিণকে খাওয়ালাম।
আরো একটু সামনে এগোলে কুমির প্রজনন কেন্দ্র। পাশাপাশি অনেকগুলি পুকুর, ডান পাশের কুমিরের বাচ্চাগুলো সবচেয়ে ছোট, পাশের পুকুরে ক্রমান্বয়ে বড় বাচ্চা রাখা আছে।
এরপর পাশের পুকুরের পাড়ে রোদ পোহাতে থাকা কুমির দর্শন করে চললাম মাংকি ট্রেইলের দিকে। মাংকি ট্রেইল মূলত একটি কাঠের পাটাতন দিয়ে তৈরি হাঁটাপথ, যা করমজল বন্যপ্রাণী আশ্রয়কেন্দ্রের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে বনের ভিতরে ওয়াচ টাওয়ার হয়ে ঘুরে দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে শেষ হয়। আমরা বেশ সকালে পৌছে গিয়েছিলাম বলে তখন মাংকি ট্রেইলে আর কোনো দর্শনার্থী ছিল না, তাই ভালো লাগছিল। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে হালকা কুয়াশা ভেদ করে আসা সূর্যের আলো একটা সুন্দর পরিবেশ তৈরি করেছিল।
The monkey trail
আমরা ধীরে ধীরে হেঁটে পুরো ট্রেইলটা ঘুরে আসি। মাঝে ওয়াচ টাওয়ারের উপরে উঠে আহামরি কিছু দেখতে পাইনি, গাছের কারণে দৃষ্টি বেশিদূর যায় না। আরো ২০ ফুট উঁচু হলে গাছের সারির উপর দিয়ে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দেখা সম্ভব হতো। এছাড়া ট্রেইলটার অবস্থাও সুবিধার ছিল না। যদিও দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে সম্প্রতি মেরামত করা হয়েছে, কিছু কাঠের পাটাতন পরিবর্তন করা হয়েছে, তবু কিছু জায়গা বিপজ্জনক মনে হয়েছে।
মাংকি ট্রেইলের শেষ প্রান্তে ট্রেইলের নামের স্বার্থকতা পেলাম। একদল বানর ট্রেইলে উপর ও পাশে বসে খেলাধুলা করছিল। ট্রেইলের শেষ প্রান্ত থেকে নেমে আমরা কিছুক্ষণ বানরের কাণ্ডকারখানা উপভোগ করলাম।
এরপর সবাই আবার বোটে ফিরে এলাম আবার নাস্তা করার জন্য। নাস্তা করে গেলাম করমজলের কচ্ছপ প্রজনন কেন্দ্র দেখতে। এখানে সংরক্ষণ করা হচ্ছে বিপন্ন প্রজাতির Northern River Terrapin কচ্ছপ, যাদের বৈজ্ঞানিক নাম Batagur baska । এই কচ্ছপগুলো বর্তমানে বিশ্বে বন্য পরিবেশে শুধু সুন্দরবনেই কদাচিৎ দেখতে পাওয়া যায়।
কচ্ছপ প্রজনন কেন্দ্রটি করমজলের মূল বন্যপ্রাণী আশ্রয় কেন্দ্র থেকে একটু দূরে, পশ্চিম দিকে। তবে সেখানে গিয়ে দেখার মতো তেমন নাই। পুরো জায়গাটা দেয়াল আর দেয়ালের উপর কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা তবে দেয়াল নিচু থাকায় ভিতরের পুকুরগুলো দেখা যায়। পুকুরের পানিতে কচ্ছপের মাথার উপরের অংশ দেখে কচ্ছপের উপস্থিতি বোঝা যায়, এইটুকুই। পানিতে থাকায় পুরো কচ্ছপ আর দেখা যায়না।
কচ্ছপ দেখার পর করমজল মসজিদে যোহরের নামাজ আদায় করে বোটে ফিরে এলাম। বেলা একটার আগেই করমজল ছেড়ে খুলনার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হলো। মাঝে মোংলা বাজারে দুপুরের খাবার কেনার জন্য বোট থামানো হয়েছিল। মোংলা বাজার ত্যাগ করি বেলা দুইটার দিকে।
মোংলা ছেড়ে আমরা এগোতে থাকলাম খুলনার দিকে। সকাল বেলা কুয়াশার জন্য নদীর দুইপাড় দেখতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছিল কিন্তু এবার সব পরিষ্কার, আকাশও ছিল মেঘমুক্ত নীল। সবই যখন ঠিকঠাক চলছিল, তখন ঘটলো একটা অঘটন…
বেলা তিনটা, বোট তখন রামপাল কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়িয়ে পানখালী ও চালনা বাজারের মাঝে। হঠাৎ বোটের ইঞ্জিন থেকে কালো ধোঁয়া বেড়িয়ে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। বোটচালক জানালেন ইঞ্জিনে পানি সরবরাহের নলে ময়লা আটকে ইঞ্জিনে পানি প্রবেশ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এতে ইঞ্জিন অত্যাধিক উত্তপ্ত হয়ে বিকল হয়ে যায় এবং ইঞ্জিনের কিছু ক্ষয়ক্ষতিও হয়। ভ্রমণের আনন্দ কিছুটা ম্লান হয়ে গেল দুশ্চিন্তায়। যাই হোক, বোটচালক ইঞ্জিনের কভার খুলে ইঞ্জিনে পানি ঢেলে ইঞ্জিন ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করতে লাগলেন। ক্ষতিগ্রস্ত অংশও মেরামত করলেন। আল্লাহর রহমতে শেষমেষ পনের মিনিটের চেষ্টায় ইঞ্জিন সচল হলো।
এতক্ষণে নদীতে জোয়ার শেষে ভাটা শুরু হয়ে গেছে। আবার সাবধানতাবশত ইঞ্জিনের উপর চাপ কম দিতে বোটের গতিও কমিয়ে দেয়া হলো। তাই স্রোতের বিপরীতে দেড় ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগলো আড়াই ঘণ্টার বেশি। এরই মধ্যে সূর্য অস্ত গিয়ে রাতের আঁধার নামলো রূপসা নদীতে। রাতের রূপসা সেতুর আলোকসজ্জা অবলোকন করে আমরা রাত সাতটায় রূপসা ঘাটে নামি।
Khan Jahan Ali Bridge at night
ভ্রমণের খরচাপাতি:
১. বোট ভাড়া: খুলনা থেকে করমজল আসা যাওয়ার জন্য ১০-১২ জন যাত্রীবাহী বোট ভাড়া ৬০০০-৭০০০ টাকার মধ্যে। বোটচালক পূর্বপরিচিত হওয়ায় আমরা ৫৫০০ টাকা দিয়েছিলাম।
২. করমজল বন্যপ্রাণী আশ্রয় কেন্দ্র প্রবেশ টিকিট: জনপ্রতি ২৩৳
৩. দুপুরের খাবার: মোংলা বাজারে কয়েকটা খাবারের দোকান আছে। এখান থেকে দুপুরের খাবার কিনে নিতে পারেন।
বোট বিকল হবার ঘটনাটা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল এবং এরকম ঘটনা যেকোনো জায়গায় ইঞ্জিনচালিত যেকোনো যানের ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে…
যা যা সাথে রাখবেন:
১. খাবার পানি: যাত্রীসংখ্যা হিসাব করে যথেষ্ট খাবার পানি সাথে নিয়ে যাবেন। অবশ্য করমজলেও আপনি বোতলজাত পানি কিনতে পারবেন।
২. লাঠি: করমজলের বানরগুলোকে দূরে রাখার জন্য। দলের একজনের হাতে একটা লাঠি থাকলেই যথেষ্ট, বানরেরা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখবে। নইলে আপনার উপর লাফিয়ে পড়ে হাত থেকে খাবার কেড়ে নিয়ে যেতে পারে। তবে লাঠি দিয়ে বানরকে আঘাত করতে যাবেন না।
৩.বড় পলিথিনের ব্যাগ: সকল প্রকার ময়লা আবর্জনা ফেলার জন্য। ব্যাগে ময়লা ফেলে সাথে করে নিয়ে আসবেন দয়া করে।
যেই নদীপথ দিয়ে করমজল যেতে হয়, সেটা পানির উপরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদীপথ হলেও পানির নিচে আছে এক স্পর্শকাতর বাস্তুতন্ত্র। নদীর পানখালী অংশকে ডলফিন অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়েছে, এরকম সুন্দরবনের বহু জীবের আনাগোনা আছে এই নদীতে। অথচ সাধারণ মানুষ আর পর্যটকেরা দেদারসে নদীতে অপচনশীল ময়লা ফেলছে। নদীর দুইপাড়ের ভারী শিল্পকারখানাগুলো কি দূষণমুক্ত? আবার মোংলায় একটা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলও হতে চলেছে, আশা করি সেখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে।
যাই হোক, এইসব শিল্পকারখানার বর্জ্য ফেলার অজুহাত দিয়ে নিজের ময়লা নদীতে ফেলানোকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করবেন না।
নিজেকে বদলান, বদলে যাবে দেশ;
নদী বাঁচলে, বাঁচবে দেশ…
ধন্যবাদ সবাইকে, বিশাল পোস্টটা পড়ার জন্য।